কৌশলে বিভ্রান্ত বাংলার তারুণ্য
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮একদল তরুণ সেবারই প্রথম ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে৷ প্রথম ভোট, তাই উদ্দীপনাও বেশি৷ ফলে নিজের ভোট গোপন রাখার বদলে সব বন্ধুবান্ধব মিলে রীতিমতো বৈঠকে আলোচনা করে ঠিক করা হলো, কাকে দেয়া উচিত এবারের তারুণ্যের ভোট৷
সেবারই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্রবার ‘না' ভোটের সুযোগ ছিল৷ দীর্ঘ আলোচনায় অতীতের অভিজ্ঞতা এবং গুরুজনদের কাছ থেকে শুনে পাওয়া স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘না' ভোট দেয়ার৷ ‘না' ভোট দিলে তারপর কী হবে, তা তাঁদের জানা ছিল না৷ কিন্তু তাঁদের মনে হয়েছিল, তথাকথিত রাজনীতিকে এভাবেই প্রত্যাখ্যান করা যাবে৷
নির্বাচনের দিন সকালে যথারীতি উৎসবমুখর পরিবেশে তাঁরা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দলবেঁধে রওয়ানা হলো ভোটকেন্দ্রের দিকে৷
পথিমধ্যে দেখা একটি দলের বড় নেতা এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে৷ নির্বাচনি কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি অপর দলের নানা কুকীর্তি তুলে ধরে অনুরোধ করলেন তাঁর মার্কাতেই সিলটা দেয়ার জন্য৷
মুখের ওপর ‘না' না বলে ভদ্রতা দেখিয়ে তরুণেরাও ‘হ্যাঁ অবশ্যই' বলে যেই না আবার রওয়ানা দিয়েছেন কেন্দ্রের দিকে, অমনি পেছন থেকে একটা মন্তব্য ভেসে এলো, ‘‘অবশ্য তোদের বলে লাভ কি, তোরা তো অমুক মার্কাতেই ভোট দিবি৷''
অতঃপর তরুণেরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সেই অমুক মার্কাতেই ভোট দিয়ে এলেন৷ উল্লেখ্য, সেই তরুণেরা প্রায় সকলেই একটি বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন৷
যে কারণে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গল্পের অবতারণা, তার সাথে একাদশের মিল আরো বেশি৷
কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের রাজনীতি কেন করেন? বা এই দলটিকেই কেন ভোট দেন? এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে দু'টি৷ কোনো এক ব্যক্তিকে আমার ভালো লাগে৷ অথবা কোনো দলের আদর্শ আমার ভালো লাগে৷ কোনো ব্যক্তিকে ভালো লাগলে সেটা ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু সংসদ নির্বাচন তো আর ব্যক্তি দিয়ে হয় না, এটা সামগ্রিকভাবে দলের আদর্শ দিয়েই পরিচালিত হয়৷ ফলে, আমার আলোচনাটাও দলকেন্দ্রিক৷
বাংলাদেশের দলগুলিকে মোটামুটি আদর্শের দিক দিয়ে একসময় চারভাগে ভাগ করা যেতো৷ ১) ডানপন্থি সেক্যুলার ২) ডানপন্থি অ্যান্টি-সেক্যুলারিজম ৩) বামপন্থি ও ৪) কট্টর ইসলামপন্থি৷
এই বিভাজন যত সময় গিয়েছে, আদর্শ ততই ক্ষমতার কাছে পরাস্ত হয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে৷ এখন এমন এক অবস্থানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল অবস্থান করছে, যেখানে তরুণদের আদর্শ নয়, বরং ক্ষমতা দিয়ে আকৃষ্ট করার প্রতিযোগিতাই বেশি৷
যে আওয়ামী লীগ একসময় সেক্যুলার ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে তরুণদের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে, আজ তার অবস্থান কোথায়? ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে যুক্তি দেখানো দলটি কি আর নিজেদের সেক্যুলার দাবি করতে পারে?
এটা সত্যি যে, চার দশকেরও বেশি সময় পর এই দলের নেত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগ না নিলে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুধু স্বপ্নেই দেখতে হতো৷
কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের রায় কার্যকর হওয়ার পর থেকে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার যেন এখন এক বাচ্চাদের ভয় দেখানো ‘জুজু'তে পরিণত হয়েছে৷ ছোট বাচ্চাদের যেমন ‘ভাত না খেলে ভূত আসবে' বলে ভয় দেখানো হয়, এখনও দলটির নেতারা যে-কোনো অপকর্ম ঢাকতেই জনগণকে ‘জামায়াতে ইসলামীর' ভয় দেখান৷
জামায়াতে ইসলামীর বিচারে এখনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি কেন! উত্তরটাও দলের সাধারণ সম্পাদকের কল্যাণে সবার জানা, ‘‘এটা আদালতের এখতিয়ারে আছে।'' ভাবখানা এমন, আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে তাঁরা কখনোই কথা বলেননি৷ আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেও প্রায় প্রতিদিনই ‘খালেদার বিচার হবেই' বলতে তাঁদের বাধে না, শুধু জামায়াতের বেলাতেই কেন জানি আটকে আটকে যায়৷
একদিকে সেক্যুলার ভাব ধরে, অন্যদিকে হেফাজত ও অন্য ধর্মজীবী দলগুলোর সাথে সখ্য করে তরুণদের আওয়ামী লীগ কি বার্তা দিচ্ছে, তা বোধগম্য নয়৷ এটা কৌশল, মানলাম৷ কিন্তু সেটা কিসের জন্য, কার স্বার্থে, তরুণরা বিশ্বাস করবে কিভাবে!
২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়৷ কিন্তু গত ১০ বছরে ‘সংখ্যালঘুবান্ধব' হিসেবে ধরে নেয়া দলটি ক্ষমতায় থেকে কি সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে পেরেছে? না৷ বরং একের পর এক রামু, নাসিরনগরের ঘটনা ঘটেই গেছে৷
বিএনপির অবস্থা তথৈবচ৷ প্রাণ গেলেও জামায়াতকে ছাড়া চলবে না৷ কিন্তু কেন? সূর্য কোন দিকে ওঠে, এ নিয়েও বিরোধ সম্ভব, কিন্তু এই এক বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাথেও তাঁরা একমত- ‘‘আদালতে আগে রায় হোক, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হলে ছেড়ে দেবো৷''
দলটির মাঝারি আকারের এক নেতাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘এক বাক্যে বললে আপনার দলের আদর্শ কী?'' উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘শহীদ জিয়ার আদর্শ৷'' আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘সেটার মানে কী?'' এবার বললেন, ‘‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ়৷'' এবারও পরিষ্কার না হওয়ায় বললাম, ‘‘এটার মানে কী?'' খুব বিরক্তি নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘না বোঝার কী আছে? এর মানে সবার জন্য বাংলাদেশ৷''
মেজাজ দেখে এবার একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘‘তাহলে যারা ইসলামী শাসন কায়েম করতে চায়, তাদের সাথে নিয়ে কিভাবে সবার জন্য বাংলাদেশ সম্ভব? অথবা যারা দেশটার স্বাধীনতারই বিরোধিতা করেছিল, তাদের নিয়ে কি আদৌ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব? তারা তো ক্ষমাও চায়নি৷''
উত্তরে তিনি অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে গটগট করে সেখান থেকে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন৷
নবগঠিত ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন যে আসলে কী চান, তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না৷ অথবা সেটা যে ক্ষমতা, তা জানেন, কিন্তু কাউকে বলতে চান না৷ তা না হলে একই মুখে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ বলে আবার জামায়াত প্রসঙ্গে ‘ভাসুরের নাম মুখে আনা যায় না' মনে করে চুপ থাকা, কখনো এড়িয়ে যাওয়া, কখনো সাংবাদিকের ওপর খেপে গিয়ে ‘খামোশ' বলা সম্ভব হতো না৷
স্বৈরাচারী হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির কথা আর নাই বা বললাম৷ দলটির একেক জন নেতা একেক আদর্শে বিশ্বাসী (অথবা কোনো আদর্শেই না), তা নির্বাচন এলে স্পষ্ট হয়৷ ফলে তরুণদের তাঁরা সুবিধাবাদ ছাড়া আর কি আদর্শে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন, তা আমার জানা নেই৷
ইসলামী দলগুলো তো অনেক আগেই নিজেদের অবস্থান হারিয়েছে৷ ‘নারী নেতৃত্ব হারাম' বললেও তাদের আমরা দশকের পর দশক নারীদের নেতৃত্বেই ক্ষমতায় যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে দেখেছি৷ কয়েক বছর আগে সরকারকে ‘নাস্তিক' বলে ঘোষণা দিয়ে সেই সরকারের নেত্রীকেই আবার ‘কওমী জননী' উপাধি দিতেও দেখেছি৷
বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে (যেমন সুপ্রিম কোর্টের সামনে লেডি জাস্টিস ভাস্কর্য, এয়ারপোর্টের সামনে বাউল ভাস্কর্য) সুবিধা আদায় করা ছাড়া আর কোনো আদর্শ কি তাঁরা তরুণদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন? সত্য ও ন্যায়ের পথে দেশকে পরিচালিত করার যে কথা তাঁরা বলে থাকেন, তার বিন্দুমাত্র কি তাঁরা নিজেদের আচরণে দেখাতে পারছেন?
বামপন্থি দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে৷ একসময় আওয়ামী দুঃশাসনের কথা বলে দল ভেঙে জাসদ গঠন করা নেতারা এখন সেই জাসদ নিয়েই দিব্যি আওয়ামী লীগের সাথে আছেন৷ ওয়ার্কার্স পার্টির সর্বোচ্চ নেতার সাথে মিলে জাসদের শীর্ষ নেতা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' বুলি বাদ দিয়ে হজও পালন করে এসেছেন৷ এখন আর সমাজতন্ত্রের বক্তব্য তাঁদের মুখ থেকে শোনাও যায় না৷
এই দলগুলোর বাইরে যেসব বামপন্থি দল রয়েছে, তাদের অবস্থাও তথৈবচ৷ কাগজে-কলমে ‘গণঅভ্যুত্থান' ‘সশস্ত্র বিপ্লবের' বুলি আওড়ালেও সব নির্বাচনে ঠিক ঠিক তাদের অংশ নেয়া চাই৷ ‘কী যুক্তি?', জিজ্ঞেস করেছিলাম এমন এক বামপন্থি দলের স্থানীয় এক নেতাকে৷ খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘কৌশল'।
গত বছর জার্মানিতে অবস্থানের কারণে ফেডারেল নির্বাচন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে৷ শরণার্থী, অভিবাসন, ইউরোপ, জলবায়ু, ইত্যাদি নানা বিষয়ে দলগুলোর অবস্থান খুব স্পষ্ট৷
অভিবাসন ইস্যুতে তো আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকারের মধ্যে, এমনকি দলের মধ্যেও চলেছে আদর্শিক দ্বন্দ্ব৷ কিন্তু এ বিভাজন স্পষ্ট৷ ভোটাররা যাকেই সমর্থন দিক, তাঁরা কী চান, তার প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন নির্বাচনে৷
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ‘কৌশলে' এসেই আটকে গেছে বাংলাদেশের সব আদর্শ৷ যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে এখন সব দলের টানাহ্যাঁচড়া, সেই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য কিন্তু একটাই ছিল– স্বাধীনতা৷ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক স্বাধীনতা৷
অথচ এখন যে একাদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হতে চলেছে, তাতে দেশের তরুণদের বিভ্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ একটা দলকে তাঁরা শেষ পর্যন্ত বেছে নেবেন সত্যি, কিন্তু আসলেই কোন আদর্শ তাঁরা বেছে নিচ্ছেন, সে দল সে আদর্শের পক্ষে কতটুকু জোরালো ভূমিকা রাখবে তা না জেনেই৷ তাঁরা বেছে নেবেন মন্দের ভালো৷