1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইশতাহার, তরুণ প্রজন্ম ও উন্নয়ন

মো. আমিনুল হক
১১ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ এমন এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যখন দেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা অনেক বেশি৷ ফলে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করতে গেলে তরুণদের পছন্দ, প্রয়োজন ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে৷

https://p.dw.com/p/39pix
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতিসহ জনগণের নিকট যাচ্ছেন৷ ইশতাহারে কী কী বিষয়ের প্রতিফলন থাকলে তরুণ প্রজন্ম সার্বিক উন্নতি লাভ করতে পারবে, তার সম্ভাব্য কয়েকটি ভাবনা এই লেখায় তুলে ধরা হচ্ছে৷

তরুণরা কি শুধুই একটি ভোট প্রদানের ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচিত হবে, নাকি দেশের সার্বিক কল্যাণ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, উৎকর্ষতা সাধনের সাধক, উন্নয়নের ধারক-বাহক ও চালক হিসেবে বিবেচিত হবে – ইশতাহার তৈরির সময় সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে৷

বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করা৷ সেক্ষেত্রে মানুষের জীবনমান আরও উন্নত করা, মাথাপিছু আয় বাড়ানো, তরুণ প্রজন্মকে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগ দান, ২২ শতাংশ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রচক্র থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের করা, কন্যা শিশুসহ মাতৃপ্রধান পরিবারসমূহকে সহায়তা করা ইত্যাদি কাজ করতে হবে৷ শিক্ষিত তরুণরা যেন দেশে-বিদেশে চাকরি করতে পারেন, শ্রমবাজারে ছড়িয়ে পড়তে পারেন সেই ব্যবস্থাও পরবর্তী সরকারকে করতে হবে৷

দেশের এখন প্রতিটি পরিবার তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে চায়, শিক্ষিত করতে চায়৷ দিনমজুর, বাজারের মুদি দোকানদার, কৃষক, রিকশাচালকসহ সকল শ্রেণির মানুষ তাঁদের সন্তানদের শিক্ষিত করতে চান৷ প্রতিটি অভিভাবকের চিন্তা বা উদ্দেশ্য একটিই, তিনি বাবা হিসেবে যে জীবনযাপন করেছেন, তাঁর সন্তান যেন তার চেয়ে আরেকটু উন্নত জীবনযাপন করতে পারে৷

কৃষি বা নিবিড় শ্রমঘন জীবিকার পরিবর্তে চাকরি বা ব্যবসাভিত্তিক জীবিকাই এখন কাম্য৷ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ কোটি কোটি তরুণ, যাদের সমানসংখ্যক ছেলে ও মেয়ে৷ সবাই কাজ করতে চায়, চাকরি করতে চায়৷ তাহলে তরুণদের প্রত্যাশা পূরণে নির্বাচনি ইশতাহারে এর বিশদ প্রতিফলন থাকলে দল উপকৃত হবে, তরুণ প্রজন্ম উপকৃত হবেন, উন্নত হবে দেশ৷

তরুণদের উন্নয়ন কর্মে অন্তর্ভুক্ত করা

দেশে প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ৷ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে এই বিশাল তরুণ প্রজন্মকে কর্মে নিয়োজিত করতেই হবে৷ ভবিষ্যতে তাঁরা কী ধরণের কর্মে নিয়োজিত হবেন, তরুণদের জন্য কী সুযোগ আছে এবং দলগুলো কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করবে, ইশতাহারে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ ও বিবরণ থাকা দরকার৷

এবারের নির্বাচনে ১১.৮ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ২৩ লক্ষ নতুন তরুণ ভোটার যুক্ত হয়েছেন৷ দেশের ৩ কোটি ২০ লক্ষ তরুণকে ৩০০ নির্বাচনি আসন দিয়ে ভাগ করলে প্রতি আসনে গড়ে ১ লক্ষ ৬ হাজার তরুণ রয়েছেন৷ দেশের ৪.৫ কোটি পরিবার/খানাকে ৩০০ নির্বাচনি আসন দিয়ে ভাগ করলে প্রতি আসনে গড়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার পরিবার/খানা৷ অর্থাৎ প্রতি পরিবারেই তরুণ আছে৷ নির্বাচনি ইশতাহারে দলগুলোকে সুস্পষ্টভাবে বলতে হবে যে, এই ১ লক্ষ ৬ হাজার তরুণ কী কাজ করবে৷ সংশ্লিষ্ট আসনের প্রার্থীকে পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে হবে যে, উনি কীভাবে এই সংখ্যক তরুণকে কাজে লাগাবেন৷ মনে রাখতে হবে, দেশের একজন দিনমজুরের মজুরি কিন্তু কমপক্ষে ৫০০ টাকা৷ সে অনুযায়ী ১‌০৬,০০০ জন তরুণের প্রতিদিনের ন্যূনতম মূল্যমান (১‌০৬,০০০x৫০০= ৫,৩০,০০,০০০) পাঁচ কোটি ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যবহার করতে না পারলে মূল্যবান সম্পদ (তরুণ প্রজন্ম) নষ্ট হবে৷

দেশপ্রেম বনাম উন্নয়ন ভাবনা ও তরুণ প্রজন্ম 

আজকের তরুণ প্রজন্মকে দেশীয় পণ্যের বিষয়ে সচেতন করা দরকার৷ দেশের শিল্পসাহিত্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত করা; দেশের সফল উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে অবহিত করা; সততা, নৈতিকতা এবং নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করার পাশাপাশি বিভিন্ন দলের গঠনমূলক সমালোচনা করার মতো মানসিক সক্ষমতা সৃষ্টি করা আবশ্যক৷ গণতান্ত্রিক দেশে বিভিন্ন দলীয় সমর্থকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সম্পন্ন মানসিকতা গঠন করা জরুরি৷ তরুণ প্রজন্ম সংশ্লিষ্ট এই বিষয়গুলোর উল্লেখ নির্বাচনি ইশতাহারে থাকতে হবে৷ নতুবা এ বিশাল তরুণ প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে দেশের রাজনীতি, দেশের উন্নয়ন, নিজের উন্নয়ন থেকে ছিটকে পড়বে৷ সুতরাং, ইশতাহার হতে হবে বিশাল তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক লালনকল্পে৷

নিয়ন্ত্রিত ও দক্ষ তরুণ প্রজন্ম গঠন

ডিজিটাল বাংলাদেশের বিকাশের ফলে অনিয়ন্ত্রিত মোবাইল, ভিডিও ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে৷ যার যেটি ব্যবহার করার কথা তা যেমন করছে, তেমনি যার করার কথা নয়, সেও সেটি ব্যবহার করছে৷ যে বয়সে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা না, সে সেটি ব্যবহার করছে৷ তরুণরা এতে অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিনা, সেটি নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দরকার৷ ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, স্মার্টফোন, অনিয়ন্ত্রিত ওয়াই-ফাই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার৷ দেশে শুধু যেন সনদধারী তরুণ প্রজন্ম তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্কবাণীর বিশেষ প্রতিফলন থাকতে হবে ইশতাহারে৷ শুধু যেন সনদধারী, আয়েশী ও দক্ষতাহীন তরুণ প্রজন্ম গড়ে না উঠে৷

একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমানে দেশে ৪০ শতাংশ তরুণ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করছে না, কোনো ট্রেনিংও নিচ্ছে না এবং কোনো কর্মেও নিয়োজিত নেই৷ উন্নয়নশীল একটি দেশে কর্মহীন, দক্ষতাহীন তরুণ অকল্পনীয়৷ দেখতে হবে তরুণরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সহজলভ্য প্রযুক্তির ফলে শুধুই কি ভোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছে, নাকি উদ্যোক্তাও হতে পেরেছে৷ প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁদের জীবনে, শিক্ষায়, দক্ষতার উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে কতটুকু প্রভাব ফেলছে, তার সুস্পষ্ট হিসাব জানা প্রয়োজন৷

প্রতিযোগিতামূলক তরুণ প্রজন্ম গঠনে দল

দক্ষতা বৃদ্ধিতে, ভাল কাজ করতে, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির অঙ্গীকার ইশতাহারে থাকতে হবে৷ প্রতিযোগিতার জন্য তরুণদের মানসিকভাবে তৈরি করতে হবে যেন, তারা নিজেদের বিশ্বমানের চিন্তা করতে পারে৷ উন্নত দেশে প্রতি পাঁচজন তরুণের মধ্যে ধরে নেওয়া হয় যে, একজন উদ্যোক্তা হবে এবং বাকি চারজনকে চাকরি দেবে৷ দেশে এরকম উদ্যোক্তা সৃষ্টির মানসিকতা তৈরি করা হয়েছে কি? এ বিষয়ে দলগুলো কী ভাবছে? সত্য কথাটা তরুণদের বলতে হবে যে, চাকরির বাজার সীমিত, তবে দক্ষতা থাকলে সমাজে সেবা প্রদানের মাধ্যমে উপার্জন খুবই সম্ভব৷

ইশতাহারে তরুণদের জানাতে হবে যে, আগামী ২০৩০, ২০৩৫ অথবা ২০৪০ সালে দেশে ক্রমবর্ধনশীল অর্থনৈতিক খাতগুলো কী কী হবে এবং সে সকল খাতে সেবা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত কিনা, তা স্পষ্ট করে বলতে হবে৷ ইশতাহার হবে তরুণদের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক খাতগুলোর জন্য যোগ্য ও দক্ষ করে গড়ে তোলার দলিল৷

পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনে তরুণ সমাজকে নিয়ে দল

উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছনতার বিষয়টি খুবই সম্পর্কিত৷ আজকের বাংলাদেশের সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তরুণদের কাজে লাগাতেই হবে৷ একইভাবে রাস্তাঘাট, নালা, নর্দমা, ডোবা, মহল্লা পরিচ্ছন্ন রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ পরিচ্ছন সমাজ গঠনে কী কী পদক্ষেপ নেবেন, তরুণরা কীভাবে ভূমিকা রাখবে, তা তাঁদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বর, দেয়াল, শ্রেণিকক্ষ, ছাত্রছাত্রীদের বসবাসের হল, দোকান, বাজার, মহল্লার দালানের মধ্যবর্তী নর্দমা, শহরের বাসাবাড়ির বর্জ্য কবে কতদিনে পরিচ্ছন্ন হবে? পরিচ্ছন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিচ্ছন্ন শহর, পরিচ্ছন্ন আবাসন, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ কবে হবে? পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনের ফলে সামাজিক, মানসিক, পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু শত শত কোটি টাকা সাশ্রয় হবে৷ দেশের জিডিপি সাশ্রয়ে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ, টেকসই/বজায়যোগ্য পরিবেশ গঠনের ইশতাহার প্রয়োজন৷

সমাজ উন্নয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধকরণে দল

উন্নয়নের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সমাজের ক্ষুধা, দারিদ্র্য জয় করতে, পীড়িত, অসুস্থ, বিধবা, বয়স্ক, এতিম, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানে দলের স্বেচ্ছাশ্রমের বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে৷ একই সাথে, রাস্তাঘাট উন্নয়নে, শিক্ষার মান উন্নয়নে তরুণদের স্বেচ্ছাশ্রম উদাত্ত আহ্বান ইশতাহারে আসলে সমাজের/জাতির প্রভূত কল্যাণ হবে৷ যেমন, দেশের ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণের জন্য দেশের লক্ষ-লক্ষ পুকুরের গভীরতা বাড়ানোর মতো জরুরি কাজে তরুণদের স্বেচ্ছাশ্রম অপরিহার্য৷

যদি শুধু ভোটারকে আকৃষ্ট করার জন্য কোনো নির্বাচনি ইশতাহার হয়, তবে তা দেশের ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে না৷ ইশতাহার হতে হবে তরুণদের দলের জন্য সমর্থন আদায় করা, একইসঙ্গে প্রকৃত অর্থে তরুণদের লালন করা এবং জীবনের জন্য, জনগণের জন্য, দেশের জন্য, সর্বোপরি বিশ্বের জন্য যোগ্য করে তোলা৷ তবেই দেশের সকল পক্ষ (তরুণ প্রজন্ম, রাজনৈতিক দল ও দেশ) লাভবান হবে৷ জাতি গঠনে তরুণ প্রজন্মের উন্নয়ন ভাবনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে ইশতাহার প্রণীত হবে এই কামনা করছি৷ শুধু ক্ষমতায় যাবার মানসে অথবা ভোট-ভান্ডার বৃদ্ধির জন্য যেন ইশতাহার প্রণীত না হয়৷

মো. আমিনুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক 

বন্ধু, কেমন লাগলো লেখাটি? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য