২০১১ সালের কথা৷ একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে বিপর্যস্ত ইউপিএ সরকার৷ তখন দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন করতে মাঠে নামলেন গান্ধীবাদী নেতা আন্না হাজারে৷ নতুন দিল্লির যন্তর মন্তরে অনশন শুরু করলেন৷ তার চারপাশে তখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কিরণ বেদী-সহ অনেকে৷ তাদের সঙ্গে তরতাজা তরুণ-তরুণীরা৷ তাদের মধ্যে অনেকেই প্রথমবার কোনো আন্দোলনের অংশ হয়ে রাস্তায় নেমেছেন৷ দিল্লির সেই উন্মাদনা ছিল অভূতপূর্ব৷ জরুরি অবস্থার পরবর্তীকালে কৃষক আন্দোলনের পর এমন আন্দোলন কমই দেখেছে দিল্লি৷ তারই একদিনের ছবি আপনাদের কাছে তুলে ধরি৷
সন্ধ্যা তখন ধীরে ধীরে রাতের দিকে এগোচ্ছে৷ যন্তর মন্তরে একটা মঞ্চের উপর বসে অনশনরত আন্না হাজারে৷ সামনে সেই সময় মোমবাতি মিছিল শুরু হলো৷ মোমবাতি হাতে মানুষের স্রোত৷ তাদের মুখে একটাই গান, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’৷ অনেকের এক হাতে মোমবাতি, অন্যহাতে জাতীয় পতাকা৷
মিছিল চলতে শুরু করলো৷ যন্তর মন্তর ছাড়িয়ে ইন্ডিয়া গেটের দিকে৷ ইন্ডিয়া গেটে যখন মিছিল পৌঁছালো, তার শেষ প্রাস্ত তখন লালকেল্লা ছাড়িয়ে চলে গেছে৷ যন্তর মন্তর থেকে লালকেল্লার দূরত্ব সাড়ে সাত কিলোমিটার৷ গাইতে গাইতে মিছিল এগোচ্ছিল যন্তর মন্তর দিয়ে৷ চারপাশে একটা তরঙ্গ তৈরি করছিল৷ অচেনা, কখনো রাস্তায় নেমে আন্দোলন না করা মানুষরা গাইছিলেন, চারপাশে আন্দোলিত পতাকা, আর একটাই দাবি, দুর্নীতি শেষ করতে হবে, সরকার, রাজনীতি, সমাজ থেকে৷ কী করলে দুর্নীতি শেষ হবে? আন্না হাজারের একটাই দাওয়াই ছিল, লোকপাল করতে হবে৷ লোকপাল মানে একটি বডি,যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে যে কোনো সরকারি কর্মী, মন্ত্রী, সাংসদ, পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা যাবে৷ লোকপাল হবে স্বাধীন সংস্থা৷ তারা ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে দুর্নীতি থেমে যাবে৷ দুর্নীতি থামানোর একেবারে মেড ইজি ব্যবস্থা৷ অনেক আন্দোলন, অনশন, লড়াইয়ের পর লোকপাল বিল সংসদে অনুমোদিত হলো৷ কেন্দ্রে পালাবদল হলো৷ ইউপিএ গিয়ে এনডিএ সরকার এলো৷ দীর্ঘদিন পরে লোকপাল নিয়োগ করা হলো৷ ঠিক যেভাবে সিবিআই ডিরেক্টরকে নিয়োগ করা হয়, সেভাবেই প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে নিয়ে গঠিত কমিটি তাকে নিয়োগ করে৷
এভাবেই লোকপাল নিয়োগ করা হয়েছে৷ তিনি কাজ করছেন৷ ভারতে লোকপালের নাম কী, তা দেশের খুব বেশি মানুষ বলতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ আন্না হাজারে আবার ফিরে গেছেন রেলেগান সিদ্ধি গ্রামে৷ কেজরিওয়াল সেই আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে দিল্লিতে ক্ষমতায় এসেছেন৷ তিনিও আর লোকপালের কথা তোলেন না৷ দুর্নীতি নিয়েও বিশেষ কথা বলেন না৷ কিরণ বেদী যোগ দিয়েছেন বিজেপি-তে৷ যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তারা ফিরে গেছেন তাদের অভ্যস্ত জীবনে৷ কিন্তু লোকপাল হওয়ার পরেও দেশ থেকে, রাজনীতি থেকে, পুলিশের মধ্যে, সরকারি কর্মীদের মধ্যে কি দুর্নীতি শেষ হয়েছে? এমন কোনো দাবি আন্না হাজারে, কেজরিওয়ালরাও করছেন না৷ পরিস্থিতির ইতরবিশেষ খুব একটা হয়েছে বলে মনে হয় না৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব কয়েকটি সংস্থার হাতে৷ লোকপালের কথা আগেই বলেছি, তাছাড়া অন্য প্রধান সংস্থা হলো সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি, আদালত নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দল, রাজ্য সরকারের বিশেষ তদন্তকারী দল ও পুলিশ৷ এর মধ্যে খাতায় কলমে সিবিআই হলো স্বশাসিত সংস্থা৷ যদিও সুপ্রিম কোর্টের মতে, তারা হলো খাঁচাবন্দি তোতাপাখি৷ এদের প্রত্যেকের হাতেই দুর্নীতির গাদা গাদা মামলা রয়েছে৷ তারা সেই সব মামলার তদন্তও করছে৷ কিছু ক্ষেত্রে আদালতে চার্জশিট পেশ করছে৷
যদি এই আদর্শ পরিস্থিতি বহাল থাকতো, তাহলে আর বাড়তি কিছু লেখার দরকার হতো না৷ তখন বলতেই হতো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সরকারি সংস্থাগুলি তদন্ত করছে, ব্যবস্থা নিচ্ছে, ফলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠতো, তা আর এখন নেই৷
নারদ, সারদা এবং..
অভিযোগ, দুর্নীতির তদন্ততেও রাজনীতি ঢুকে যায়৷
পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে দুর্নীতির অন্যতম বড় দুইটি অভিযোগের নাম সারদা ও নারদ৷ সারদা কেলেঙ্কারিতে অত্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া হাজার হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে৷ অভিযোগ উঠেছে, বেশ কিছু রাজনীতিক এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, সিবিআই এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করবে৷ দীর্ঘদিন ধরে সিবিআই এই তদন্ত করে যাচ্ছে৷ পশ্চিমবঙ্গে যখনই নির্বাচন আসে, তখনই কাকতালীয়ভাবে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়৷ নির্বাচন কেটে গেলে যে কে সেই অবস্থা হয়৷
সারদায় তিনজন রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই৷ লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রয়াত সাংসদ তাপস পাল এবং বর্তমানে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ৷ তবে সুদীপ এবং কুণাল এখন জামিন পেয়ে জেলের বাইরে৷ সারদার মালিক সুদীপ্ত সেন ছাড়া আর তেমন কেউ জেলে নেই৷ কিছু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে৷ চার্জশিট জমা পড়েছে৷ তাও তদন্ত চলছে৷ গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও এই তদন্ত নিয়ে হইচই হয়েছিল৷ ফলাফল প্রকাশের পর তিন মন্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলেন সিবিআই অফিসে৷ তারপর আবার সব আপাতত ঠান্ডা৷
নারদ কেলেঙ্কারিতে ক্যামেরার সামনে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল প্রচুর রাজনীতিককে৷ সেটা নিয়েও সিবিআই তদন্ত করছে৷ সেই তদন্তও চলছে তো চলছে৷ রাজনীতিকরা যুক্তি দিয়েছেন, তারা দলের জন্য অনুদান নিয়েছিলেন মাত্র৷ তারপর দল তাদের রশিদ দিয়েছেন৷ এখনো কেন এই মামলার তদন্ত শেষ হলো না, কবে হবে, তা কেউ জানে না৷
দুর্নীতির রাজনীতি
ভারতে এখন সবকিছুতেই ঢুকে যায় রাজনীতি৷ আর রাজনীতি ঢুকলেই সবকিছুর চাল-চরিত্র চেহারা বদলে যায়৷ মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিজেপি সহ বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সরকার অন্যায়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডিকে ব্যবহার করে৷ এখন মোদীর আমলে কংগ্রেস, তৃণমূল সহ বিরোধী দলগুলি একই অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে করছে৷ তারা প্রশ্ন তুলেছে, কোনো নির্বাচন এলেই কেন সিবিআই, ইডি সক্রিয় হয়ে যায়? কেনই বা বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়? কেন তাদের বাড়িতে ইডি বা সিবিআই হানা দেয়? কেনই বা সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হয় সিবিআই খাঁচাবন্দি তোতা?
মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী নবাব মালিককে সম্প্রতি ইডি গ্রেপ্তার করেছে৷ তিনি শরদ পাওয়ারের দলের নেতা৷ তারপরেই শরদ পাওয়ারকে ফোন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিন মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করার পর মমতা কী করেছিলেন তা জানিয়েছিলেন শরদকে৷ নবাব এখনো মন্ত্রিপদ থেকে ইস্তফা দেননি৷ মন্ত্রী জেলে বন্দি, এরকম অবস্থায় পড়ে শরদ পাওয়ারও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কথা বলছেন৷
আর এখানেই শুরু হয় আসল প্রশ্ন৷ কে ঠিক বলছে, বিরোধী না সরকার? আর এই হট্টগোল, বিতর্কে আসল বিষয়ের উপর থেকে মানুষের নজর সরে যায়৷ দুর্নীতির প্রশ্ন থেকে৷
বোফর্সের মতো দুর্নীতির অভিযোগ, যার জেরে রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল, সেটা নিয়েও দীর্ঘকাল তদন্ত করে কিছু হয়নি৷ কত তো দুর্নীতির অভিযোগ এলো৷ কয়লা কালেঙ্কারি, কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি, ২জি থেকে শুরু করে একগুচ্ছ নাম নেয়া যায়৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত কি হলো? মোদী সরকারের আমলেও বিরোধীরা একগুচ্ছ দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন৷ কোনোটারই কিছু হয়নি৷
এগুলো তো খুব বড় বড় অভিযোগ৷ এর বাইরে যে দুর্নীতি হয়, হতে থাকে, তার বেলা? প্রচারের নজরে না থাকা সেই সব অভিযোগ নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়! নরসিমা রাও একখানা মোক্ষম কথা বলে গিয়েছিলেন, ‘ল উইল টেক ইটস ওন কোর্স’, মানে আইন আইনের পথে চলবে৷ আইন তার পথে চলতে থাকে, সরল, জটিল নানা পথে৷ আইনের বৃত্তের বাইরে থাকা মানুষ তার গতিপ্রকৃতি কী-ই বা বুঝতে পারে৷