তারা কিভাবে শপথ নিচ্ছেন, কেন নিচ্ছেন?
৩ মার্চ ২০১৯জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মোট ৮টি আসনে জয়ী হয় ৩০ ডিসম্বেরের সংসদ নির্বাচনে৷ এরমধ্যে বিএনপি পায় ৬টি আসন৷ আর গণফোরাম পায় দু'টি৷ গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি'র ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয়ী হন৷ সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরাসের উদীয়মান সূর্য প্রতীক জয়ী হন মোকাব্বির৷ অনেক নাটকীয়তার পর তারা জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তারা ৭ মার্চ সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে চান৷ স্পিকারের কার্যালয় থেকেও সেরকম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে৷
এর আগেও তাদের দু'জনের শপথ নেয়ার কথা উঠেছিল৷ তারা শপথ নেবেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েও ছিলেন৷ কিন্তু তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হেসেন সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে, তারা শপথ নেবেন না৷ শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত বহাল আছে৷ ৩০ জানুয়ারির নির্বাচনকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আগেই প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানায়৷ আর আর বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট থেকে যে ৮ জন নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তারা শপথ নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়৷
দুইজন যা বললেন
শনিবার বিকেলে গণফোরামের দুইজন শপথ নেয়ার জন্য স্পিকারকে চিঠি দেয়ার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরামের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি৷ তবে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোকাব্বির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শপথ না নেয়া বা সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের দলে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ বরং সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের দল ইতিবাচক৷ দলের পক্ষ থেকে সংসদে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে৷ দলে ভিন্নমত আছে৷ জোটেও আছে৷ সেটা আলাদা কথা৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার সংসদীয় এলাকার মানুষ আমাকে সংসদে গিয়ে তাদের কথা বলার জন্য ভোট দিয়েছেন৷ আমার দায়িত্ব হলো সংসদে গিয়ে তাদের জন্য কথা বলা৷ আমার মনে হয় আমাদের জোটের আরো যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরও যাওয়া উচিত৷ তাহলে আমরা সবাই একসঙ্গে সংসদে বলতে পারব এই সরকার কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে৷ প্রশাসনের মাধ্যমে টিকে আছে৷ আমার আশা আমাদের শপথ গ্রহণ বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের শপথ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে৷''
এদিকে, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা দু'জন ৭ তারিখ শপথ নেয়ার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিয়েছি৷ এর বেশি এখন আর কিছু বলবো না৷ যা বলার শপথ নেয়ার পরই বলবো৷''
কী কারণে শপথ নিচ্ছেন এবং দলের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘শপথ নেয়ার আগে কিছু বলবো না৷''
গণফোরামের অবস্থান
এ নিয়ে কথা বলার জন্য গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি৷ তবে গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা ও দলের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা শপথ নিচ্ছেন তারা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে শপথ নিচ্ছেন, দলের কোনো সিদ্ধান্তে নয়৷ আমাদের দলীয় ফোরামে এর আগের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ সেখানে শপথ না নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে৷''
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে শপথ নিলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে৷ আজ(রবিবার) বিকেলেই আমরা বৈঠক ডেকেছি৷ সেখানে সাধারণ সম্পাদকসহ যারা আছেন তারা থাকবেন৷ বৈঠকে আমরা আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করব৷''
বিএনপি নেতারা যা বলেন
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি৷ বিএনপি এখনো নির্বাচিত ৬ জনের শপথ না নেয়ার ব্যাপারে অনঢ় আছে৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সিদ্ধান্ত আছে শপথ না নেয়ার৷ এটা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরও সিদ্ধান্ত৷ তারপরও গণফোরামের দু'জন কেন শপথ নিচ্ছেন এটা তাদের দলীয় বিষয়৷ দায়-দায়িত্ব তাদের নিতে হবে৷ আমরা এটা নিয়ে মিটিং করবো৷ আলোচনা করবো৷''
বিএনপি'র ৬ জনও শপথ নিতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি৷ আমরা এটা নিয়েও আলোচনা ও বৈঠক করবো৷ তার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা৷''
আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তারা অনৈতিক কাজ করছেন৷ বিশেষ করে একজনতো ধানেরশীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন৷ তারা ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করছেন৷ নিশ্চয়ই ফ্রন্টের বৈঠকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
সংবিধানে কী আছে?
৩০ জানুয়ারি একদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছে৷ সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচিত কোনো সদস্য সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক থেকে ৯০ দিনের মধ্যে যদি শপথ গ্রহণ না করেন তাহলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে৷
আর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তা হলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে৷ তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হবার অযোগ্য হবেন না৷
এই বিধান অনুসারে পদত্যাগ ও বিপক্ষে ভোট দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে পদশূন্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ এখানে দল থেকে বহিষ্কারের কথা কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি৷
কোনো দল তার সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করলে দলের পক্ষ থেকে সংসদের স্পিকারকে চিঠি লিখে ৭০ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করার কথা জানাতে হবে৷ স্পিকার যদি মনে করেন ৭০ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ হয়েছে তখন তিনি বিষয়টি শুনানির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাবেন৷ আর কমিশনের শুনানিতে সন্তুষ্ট না হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন৷ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার দায়ে কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জটিল এবং কঠিন বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷
প্রসঙ্গত, নবম জাতীয় সংসদে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এইচ এম গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিল৷ কিন্তু সংসদে তিনি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে টিকে ছিলেন৷