খালেদা জিয়ার কারাবাসে লাভ-ক্ষতি
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসন পেয়েছে মাত্র ৬টি৷ বিরোধী দলে বসার মতো আসনও পায়নি তারা৷ তবে তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে৷ আর তাদের যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তারা শপথও নেবেন না৷ সামনের উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না বিএনপি৷ তাহলে থাকে আন্দোলন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি৷ বিএনপি গত ৫ বছরে কোনো কার্যকর আন্দোলন যেমন গড়ে তুলতে পারেনি, তেমনি খালেদা জিয়ার মুক্তির কোনো পথও তৈরি করতে পারেনি৷ তাই এখন কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে৷
১. খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বিএনপি কেন কোনো জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি?
২. নির্বাচনে খালেদা জিয়া ইস্যুকে কেন তারা বড় করে সামনে আনতে পারেনি?
৩. খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে বিএনপি'র ভবিষ্যৎ কী?
গত বছরের এইদিনে (৮ ফেব্রুয়ারি) জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলে বিএনপি'র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়৷ তাঁর কারাবাসের এক বছর পূর্ণ হলো৷ এরইমধ্যে আদালত ওই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছে৷ এরপর গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় একই আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন৷
এই দু'টি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো ৩৩টি মামলা আছে, যার মধ্যে ২২টি বিচারাধীন৷ তদন্ত চলছে আটটির এবং আদালতের নির্দেশে তিনটি মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে৷ তাই পরিস্থিতি একই রকম থাকলে খালেদা জিয়াকে আরো অনেক মামলাই তাড়া করতে পারে৷ আর আদালতই বলতে পারবেন তার ফল কী হবে৷ কিন্তু মামলার যা সংখ্যা, তাতে এগুলো নিস্পত্তি হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে৷
খালেদা জিয়া জেলে থাকায় লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন৷ খালেদা জিয়াও দলকে কারাগার থেকে যেভাবে সম্ভব নির্দেশনা দেন৷ তাই বলা যায় বিএনপি এখনো খালেদা-তারেকের নির্দেশনা অনুযায়ীই চলছে৷ কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?
বিএনপি'র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে রাখা হয়েছে৷ আমাদের বিএনপি, ২০ দল বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের লক্ষ্য ছিল একটি আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনা৷ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা৷ কিন্তু খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারার, মুক্তির কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা আমরা স্বীকার করি৷ আইনজ্ঞসহ সবাই মত দিয়েছিলেন, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই তাঁকে বের করা হবে এবং বের করে আনা সম্ভব হবে৷ আর নির্বাচনে অবশ্যই খালেদা জিয়া একাটি বড় ইস্যু ছিলেন৷ কিন্তু ভোটতো হয়ে গেছে ২৯ তারিখ রাতে৷ ৩০ ডিসেম্বর কোনো ভোট হয়নি৷ ২৯ ডিসেম্বর রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট ডাকাতি হয়েছে৷ যদি সত্যিকারের ভোট হতো, তাহলে এই নির্বাচন হতো খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার মধ্যে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না৷ তাঁর জীবন বিপন্নের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে৷ তাঁকে রাজনৈতিক কূটচালের মাধ্যমে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে৷ এর পিছনে আইনের কোনো বৈধতা নেই৷ পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমানকেও মিথ্যা মামলায় কারাগারে রাখা হয়েছিল৷’’
বিএনপি'র ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে বিএনপি'র কোনো ক্ষতি হবে না৷ একটি রাজনৈতিক দল আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে যায়৷ তবে দেশের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷’’
এর বিপরীতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়াকে যখন জেলে ঢোকানো হয়েছে, তারপর বিএনপি'র যে চাপ সৃষ্টি করা দরকার ছিল, বিএনপি সেটা করতে পারেনি৷ এর মানে হলো বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল৷ বিএনপি যেটা করেছে, তারা হিংসাত্মক পথ থেকে সরে এসেছে৷ প্রশ্ন হলো খালেদা জিয়া বিএনপি'র থেকে বড় কিনা৷ কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জেলে এবং তারেক বাইরে থাকায় বিএনপি'র এই অবস্থা৷আমার কথা হলো, শেখ সাহেব যখন জেলে ছিলেন তখন আওয়ামী লীগ থেমে ছিল কিনা৷’’
বিএপি নির্বাচনে খালেদা জিয়া ইস্যুকে কার্যকরভাবে কেন ব্যবহার করতে পারলনা? এ প্রসঙ্গে আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘এক এগারোর সময় যখন সেনাবাহিনী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ধরেছিল, তখন মানুষ এটাকে দেখেছে রাজনৈতিক নেতাদের আটক হিসেবে৷ কিন্তু এবার যখন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়, তখন মানুষ এটাকে সেভাবে নেয়নি৷ মানুষ কি তার জন্য রাস্তায় নেমেছে? এখনো কি নামবে?’’
খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখা রাজনীতির কোনো কূটচাল কিনা জানতে চাইলে আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘এটা বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্র৷ কেউ কাউকেই ছাড়ে না৷ ছাড় দেয় না৷ সরকার খালেদা জিয়াকে কষ্টের মধ্যে রেখেছে বলা যায়৷ এবং এটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবে৷ কারণ, আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি এমন একটি দল, যারা তাদের সব নেতাদের হত্যা করার চেষ্টা করেছে৷’’
আফসান চৌধুরী আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা পরিবর্তন এসেছে৷ এখন আমরা দেখছি রাজনৈতিক রাষ্ট্র থেকে আমরা প্রশাসনিক রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছি৷ আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে এগোচ্ছে৷ এখানে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনেক কম৷ বিএনপি এটা ধরতে পারছে না৷ আর তারা তো দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসন-বিচ্ছিন্ন আছে৷ চরিত্রের দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একই ধরনের দল৷ তাই বড় প্রশ্ন এখন একই ধরনের দুটি দল একই দেশে শেষ পর্যন্ত চলবে কিনা৷’’
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘যদি অসম্ভব কিছু না ঘটে, আমার কাছে মনে হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিদায়ের পালা এখন৷ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে এসেছে৷ তাঁর বয়সও তো হয়েছে৷’’