পুলিশ প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকজন জঙ্গিকে সে রাতে আটকও করেছিল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত জঙ্গিরা পুলিশের অস্ত্র ও তাদের সঙ্গীদের ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এ ঘটনার মামলার বিচার এখনও হয়নি৷ এই ঘটনায় জেএমবির ১৪ শীর্ষ নেতা এখনও পলাতক৷ বিশ বছর আগের এই ঘটনার রেফারেন্স টানার কারণ সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ সদস্যদের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালিয়ে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার খবর৷ বিশ বছর আগে জঙ্গিদের সম্পর্কে ধারণা এবং পুলিশি সামর্থ্য অনেক কম ও দুর্বল ছিল৷ রিপোর্টার হিসেবে ঘটনাটি তখন আমি নিজে কাভার করেছিলাম, দেখেছিলাম- জঙ্গিদের বিস্তার, সামর্থ্য সম্পর্কে সে সময়ে পুলিশের তেমন কোনো ধারণাই ছিল না৷ কিন্তু এখন জঙ্গি দমনে আইনশৃংখলা বাহিনির নানা বিশেষায়িত উইং হয়েছে, তাদের সক্ষমতাও বেড়েছে অনেক গুণ৷ তা সত্ত্বেও দিনেদুপুরে যেভাবে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল, তা সাধারণ জনমনে উদ্বেগ ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের মতামতধর্মী লেখাগুলোতে মূলত নিরাপত্তার দুর্বলতা এবং কর্তব্যরত পুলিশের গাফিলতিকে দায়ী করা হয়েছে৷ অনেকে প্রসঙ্গক্রমে পুলিশের হেফাজত থেকে আসামি ছিনতাই ও পালিয়ে যাওয়ার পৌনঃপুনিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে টেনেছেন৷ কিন্তু সাধারণ আসামী ছিনতাই বা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আর জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাকে এক পাল্লায় মাপা কি ঠিক হবে?
দেখা যাক, বাংলাদেশে আইনশৃংখলা বাহিনির হেফাজতে থাকা আসামি ছিনতাই বা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা কতটা পৌনঃপুনিকভাবে ঘটে৷ গুগল সার্চ ইঞ্জিনে ‘আসামি ছিনতাই’ ও ‘আসামি পলায়ন’ এই দুইটি কীওয়ার্ডের মাধ্যমে খোঁজ করে চলতি বছরের ১১ মাসে ২৯টি ঘটনায় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পাওয়া গেছে৷ এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসে কোনো ধরনের আসামি ছিনতাই বা পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়নি৷ মার্চ, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি- চারটি করে ঘটনা ঘটেছে৷ সবচেয়ে কম ঘটেছে জুন ও আগস্ট মাসে৷ ২৯টি ঘটনায় মোট ৩২ জন আসামি পালিয়ে গিয়েছে৷ এই হিসাব থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, গড়ে বাংলাদেশে প্রতিমাসে আসামি পালিয়ে যাওয়া বা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার একাধিক খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশের ওপর আক্রমণ, কখনও কখনও পুলিশকে গুলিবিদ্ধ করে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে৷ ফলে দেখা যাচ্ছে, আসামি আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিরাট একটা গলদ রয়ে গেছে৷ সেদিক থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং পুলিশের গাফিলতি যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে বিবেচিত হয়৷ কারণ বারবার রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মত বড় শহরের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একই ধরনের ঘটনা ঘটলেও পুলিশের কাছে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি বলে প্রতীয়মান হতেই পারে৷
কিন্তু ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত পাড়া থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা আলাদা গুরুত্ব বহন করে৷ তার আগের রাতে চট্টগ্রামে পুলিশ বক্সে হামলা চালিয়ে দুই আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল৷ কিন্তু চট্টগ্রামের ঘটনাটি ততটা প্রচার পায়নি বা এটি নিয়ে ততটা আলোড়ন তৈরি হয়নি৷ চট্টগ্রামের ঘটনায় শহরজুড়ে রেড এলার্ট জারি না হলেও ঢাকার ঘটনায় সরকারের তড়িৎ কিছু পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবে এই বার্তা দেয় যে, ঘটনাটি কতটা গুরুত্ববহ৷ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে দুই জঙ্গির সন্ধান দিতে ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল৷ ঢাকার আদালত পাড়ার ঘটনাটি আলাদা গুরুত্ব বহন করার কারণ হলো ছিনিয়ে নেয়া আসামিরা হলো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি৷ দুজন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য৷ তাঁরা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি৷ জঙ্গি সংগঠনটির পরিকল্পনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও সমকামী অধিকারকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল৷
স্বাভাবিকভাবে এটা ধরে নেয়া যায় যে, এ ধরনের জঙ্গিদের পুলিশি হেফাজতে রাখার সময় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে৷ অতীতে আমরা সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখেছি৷ তাহলে ২০ নভেম্বর কেন নেয়া হলো না? যেখানে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল আনসার আল ইসলামের মূল নেতা মেজর (বরখাস্ত) জিয়া পলাতক এবং তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি৷ এমনকি পুলিশ হেফাজত থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার অতীত রেকর্ডও যেখানে আছে সেখানে এ ধরনের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা শুধু কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের গাফিলতি বললে বিষয়টির সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে একেবারে অলক্ষ্যেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে৷ ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে এবং এক পুলিশকে হত্যা করে জেএমবির দণ্ডপ্রাপ্ত তিন নেতাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা৷ তাদেরই একজন জঙ্গি নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন এখনও পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে৷
এটা ঠিক যে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার পর থেকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনী ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল৷ এ সাফল্যের পর সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকার এবং পুলিশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা সফলভাবে জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক রোলে মডেলে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করে আসছেন৷ ২০১৭ সালের ২৮ জুন সংসদে এক প্রশ্ন-উত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘জিরো টলারেন্স' নীতির আওতায় কার্যকর পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে জঙ্গি দমনে সারা বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে৷ ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এর তৎকালীন প্রধান মনিরুল ইসলাম ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘‘অনেকেই শুধুমাত্র ধারণা করে আইএস আছে, আল-কায়েদা আছে, জঙ্গি আছে৷ বড় ধরনের হামলা হতে পারে৷ কিন্তু এরকম ভয়ের কোন কারণ নেই৷ বাংলাদেশ জঙ্গি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে৷ এ সবের কোনো অস্তিত্বই বাংলাদেশে নেই৷’’ মূলত জঙ্গি দমনের লক্ষ্যেই কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটটি গঠন করা হয়েছিল৷ সে ইউনিটের প্রধান যখন বলেন দেশে জঙ্গি নেই তারপর যখন আমরা পত্রপত্রিকায় খবর দেখি পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর সাথে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আদালত পাড়ায় জঙ্গিদের দিনে-দুপুরে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে- তখন সে বক্তব্যকে আত্মতুষ্টি বললে কি খুব বেশি অত্যুক্তি হবে?
বিএনপি আমলে ২০০২ সালে যখন জঙ্গি বিষয়ক রিপোর্টিং শুরু করি তখনকার পুলিশ ও সরকারী কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এই ধরনের বক্তব্য দিতে দেখেছিলাম৷ ২০০৪ সালে সিআইডি এক বিশেষ প্রতিবেদনে যখন সরকারকে অবহিত করেছিল যে, উদীচী ও রমনা বোমা হামলাসহ ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যতগুলো বোমা হামলা হয়েছে সবগুলো একই জঙ্গি গোষ্ঠীর কাজ, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, দেশে জঙ্গিবাদ বলে কিছু নেই৷ এমনকি পরে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানকে তারা ‘মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে দাবি করেছিল৷ এখানে একটি কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জঙ্গি দমনে কার্যকর অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং সফলও হয়েছিল৷ কিন্তু জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর জঙ্গি দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীর যতগুলো ইউনিট কাজ করছে তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ জঙ্গি বিষয়ক রিপোর্টিং অভিজ্ঞতা থেকে একটি কথা বলতে পারি, বাংলাদেশের গোয়ন্দা সংস্থাগুলো জঙ্গি দমনে সাময়িক সাফল্য পেলেও জঙ্গিদের গোড়ার দিককার মূল নেতাদের গ্রেপ্তার, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন, তাদের এত বছরের আর্থিক যোগানদাতাদের সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানতে পেরেছে, অথবা হয়তো এসব সম্পর্কে জানতে তাদের খুব বেশি আগ্রহ নেই৷ উপরন্তু অনেক মূল নেতা বিভিন্ন সময়ে জামিনে বের হয়ে যাওয়ার পর আইনশৃংখলা বাহিনি আর তাদের কোন খোঁজ পায়নি৷ বাংলাদেশে প্রথম বড় ধরনের জঙ্গিবাদের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়৷ ওই সময় গ্রেপ্তার হলেও পরে ছাড়া পাওয়ার পর মিল্লাত বাহিনির প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমানকে আর কখনও খুঁজে পায়নি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো৷ বিশ বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনও রমনা বোমা হামলার সকল আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে গঠিত বিশেষ বাহিনীগুলো৷ বাংলাদেশে জঙ্গি বিষয়ে যারা কাজ করেন তারা মোটামুটি সবাই জানেন, বাংলাদেশে আগে পরে যতগুলো বোমা হামলা হয়েছে তার সাথে রমনা বোমা হামলার প্রথম চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামি কোনো না কোনোভাবে জড়িত৷ সম্প্রতি রমনা বোমা হামলার আসামি মুফতি শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা গেলেও এতদিন ধরে তার অর্থের যোগানদাতাদের কোনো হদিস আমরা পাইনি৷ ১৯৯৬ সালে এসি এন পালিতের নেতৃত্বে উখিয়া-টেকনাফে গ্রেপ্তার হওয়া ৪১ জন জঙ্গিরা জামিন পাওয়ার পর আর কখনই তাদের খোঁজ রাখেনি আইনশৃঙখলা বাহিনিগুলো৷ ২০০৩ সালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের পর থেকে পলাতক আছে উত্তরবঙ্গের ১৪ জন জঙ্গি, যাদের কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি৷ এর মধ্যে সালেহীনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও জঙ্গিরা তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল৷ পরবর্তীতে প্রত্যেকটি জঙ্গিবাদের ঘটনায় এই ১৪ জঙ্গির সম্পৃক্ততার কথা কোনো না কোনোভাবে এসেছে৷ দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনির জঙ্গি দমনে যে সক্ষমতা তা সাময়িক বা ঘটনাভিত্তিক৷ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করে দেশের জঙ্গিবাদের মূল হোতাদের গ্রেপ্তারে অথবা দীর্ঘমেয়াদি নজরদারিতে তাদের সাফল্য প্রশ্নসাপেক্ষ৷ এই ধরনের একটি বড় গ্যাপ রেখে শুধু ঘটনার পর রি-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে বল প্রয়োগ বা হার্ড এপ্রোচ নীতি প্রয়োগ করলে রোল মডেলের রেকর্ড যে হুমকির মুখে পড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য৷