জঙ্গি ছিনতাই : ব্যবস্থা প্রহরার, নাকি জঙ্গিদের ‘সহায়তার’?
২১ নভেম্বর ২০২২তাই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ বা কারাগারের ভিতরের কারো হাত আছে কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে৷
রবিবার জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে তা স্পষ্ট৷ এই ঘটনায় তাই পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ আর জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ২০১৪ সালেও পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়া হয়৷ শুধু জঙ্গি নয়, পুলিশ হেফাজত থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷
রবিবার ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করেছে৷ মামলায় বলা হয়েছে , যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তাদের আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যে, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা আদালতের কাজ শেষে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেবে৷ মোট চারজনকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল৷ এজন্য তিনটি মোটরসাইকেলও প্রস্তুত ছিল৷ কিন্তু দুইজনকে নিতে পারলেও বাকি দুইজনকে পারেনি৷ তারা একটি মোটর সাইকেলও ফেলে রেখে যায়৷
ওই চার জঙ্গিসহ মোট ১২ জন আসামিকে আদালতে নেয়া-আনার জন্য মাত্র তিনজন কনেস্টবল দায়িত্বে ছিলেন৷
আদালতে কাজ শেষে বের হওয়ার সময় ওই চার জঙ্গির সঙ্গে মাত্র একজন কনেস্টবল ছিল৷ পাবলিক প্রসিকউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “তাদের নিরাপত্তা ছিল খুবই ঢিলেঢালা৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি এবং সাধারণ আসামিদের একই সঙ্গে আনা হয়৷ জঙ্গিদের এক হাতে হ্যান্ডকাফ ছিল৷ কোনো ডান্ডাবেড়ি পরানো ছিল না৷ আর একজন কনস্টেবল মাত্র তাদের নিরাপত্তায় ছিল৷”
তার কথা, ‘‘এইভাবে সাধারণ আসামিদের মতো তাদের আদালতে আনায় আমি বিস্মিত হয়েছি৷ এখানে দায়িত্বে অবহেলা স্পষ্ট৷’’
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আদালতে আটক আসামি আনার প্রক্রিয়া হলো, যে থানার মামলায় আসামিদের হাজিরা, সেই থানার পুলিশ কারাগারে গিয়ে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসবেন৷ এরপর আদালত এলাকায় এনে প্রসিকিউশন পুলিশকে (কোর্ট পুলিশ) বুঝিয়ে দেবেন৷ তারা আসামিদের প্রথমে কোর্ট হাজতে রেখে তারপর আদালতে হাজির করবেন৷ আদালতের কাজ শেষে তারাই প্রিজন ভ্যানে উঠিয়ে দেবেন৷ এরপর আবার কারাগার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নিয়ে গিয়ে কারাগারকে বুঝিয়ে দেবেন৷
এই দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে প্রসিকিউশন বা কোর্ট পুলিশের কাছে থাকা অবস্থায়৷ তবে হ্যান্ডকাফ, হেলমেট ডান্ডাবেড়ি এগুলো কারাগার থেকেই পরানোর কথা৷
ওই জঙ্গিদের ঢাকার আদালতে আনা হয়েছিল কাসিমপুর কারাগার থেকে৷ কাসিমপুর কারাগারের জেল সুপার তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, “আমাদের দায়িত্ব হলো কারাগারের ভিতরে৷ আদলাতে আসামিদের নেয়া এবং কারাগারে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব কোর্ট পুলিশ ও থানা পুলিশের৷ আমরা তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আসামিদের রেডি রাখি৷ তারা কীভাবে নেবেন, হ্যান্ডকাফ বা ডান্ডাবেড়ি পরাবেন কিনা তা তাদের দায়িত্ব৷ হ্যান্ডকাফ তারাই নিয়ে আসেন৷”
প্রসিকিউশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, ‘‘আসামিদের নিরাপত্তার জন্য জেল কোডেই বলা আছে৷ কাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে, কাদের শুধু হ্যান্ডকাফ- এটা জেলখানাই নির্ধারণ করে৷ আমরা কারাগারকে আগেই জানিয়ে দিই আসামি কী প্রকৃতির৷ আমরা এই জঙ্গিদের ব্যাপারেও জানিয়েছিলাম৷’’
তার মতে, “ওই জঙ্গিদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেয়া হয়নি৷ মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কারাগার থেকেই হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও ডান্ডাবেড়ি পরানোসহ আরো যেসব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল তা নেয়া হয়নি৷ তাদের সাধারণ আসামিদের সঙ্গে আনাও ঠিক হয়নি৷ আমরা জঙ্গি বা দুর্ধর্ষ আসামিদের আলাদাভাবে আনতে বলি৷”
তবে আদালতে আনার পর জঙ্গিদের নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথভাবে নেয়া হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন৷ তিনি এজন্য জনবলের অভাবকে দায়ী করেন৷ তিনি বলেন, “আমার জনবলের সংকট আছে৷ প্রত্যেকদিন গড়ে ৫০০-৬০০ আসামি আসে৷ তাদের জন্য আমার আছে ১৫০ জন পুলিশ সদস্য৷ তাই পর্যাপ্ত পুলিশ জঙ্গিদের সঙ্গে দেয়া যায়নি৷”
এখন পর্যন্ত জঙ্গিদের ঘটনায় যে পাঁচজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তারা সবাই প্রসিকিউশনের৷
আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার অবশ্য বলেন, “২০১৭ সালের মার্চে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো নিষিদ্ধ করেন৷ এটা জেলখানার মধ্যে কোনো অপরাধ করলে তার একটি শাস্তি৷ তবে আদালত আসামিদের ধরন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তার কথা বলেছে৷ আসামিদের অপরাধ ও ধরন বুঝে এটা করতে বলা হয়েছে৷”
তিনি বলেন, “জেল কোড অনুযায়ী, আসামিদের আদালত পর্যন্ত আনা এবং নিয়ে যাওয়া ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব৷ বাকিটা দেখে প্রসিকিউশন পুলিশ৷”
এসব বিষয় নিয়ে আইজি প্রিজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি৷
পুলিশের সাবেক ডিআইজি এবং গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, “এখানে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও আছে৷ এমনকি এই ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদেরও হাত থাকতে পারে৷ তা না হলে জঙ্গিরা আগে থেকে কীভাবে জানবে যে তাদের ছিনিয়ে নেয়া হবে৷ জঙ্গিদের সাথে তো কারো দেখা করার সুযোগ থাকার কথা না৷ আর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জঙ্গি জানার পরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা উদ্দেশ্যমূলকও হতে পারে৷”