সাধারণত এমন কড়া নিরাপত্তা নেয়া হয় দুর্ধর্ষ আসামির ক্ষেত্রে, যার জীবনের উপর হুমকি আছে অথবা পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷
পরিমনি সে রকম আসামি না হলেও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত করা হয় তার জন্য৷ শুধু তাই নয়, পুলিশের কর্মকর্তা পর্যায়ের কয়েকজন উপস্থিত থেকে পরিমনির নিরাপত্তার বিষয়টা তদারকি করে৷
অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের বা বড় সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তার বেলায় উল্টো চিত্র দেখতে পাই আমরা৷ এদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয় না৷ নামকাওয়াস্তে স্বল্প সংখ্যক পুলিশ দেয়া হয়, যা না করলেই নয়৷
অনেক ক্ষেত্রে জনবলের অভাবের কারণে পর্যাপ্ত পুলিশ দেয়া সম্ভব হয় না বলে দাবি করা হয়৷ সে যুক্তি যে সঠিক না তা পরিমনির উদাহরণ টেনে বলা যায়৷
বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে পুলিশের সংকট হওয়ার কথা না৷ দেশে জঙ্গি হামলা নেই, রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটছে না আবার বড় ধরনের অপরাধও খুব একটা দেখা যায় না৷ এমন পরিস্থিতে আদালত প্রাঙ্গণ ও জেল থেকে আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার সময় তাদের নিরাপত্তায় যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ নিয়োজিত করাই স্বাভাবিক৷ তবে তা করা হয় না৷
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন আসামিদের নিরাপত্তা ও আদালত প্রাঙ্গণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয় না?
এর পেছনে দুর্নীতি, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা এবং জবাবদিহির অভাব এই তিনটি বড় কারণ বলে আমি মনে করি৷
প্রথমেই আসা যাক দুর্নীতির বিষয়টায়৷ কারাগারের মত আদালতেও টাকা দিয়ে অনেক কিছু করা যায় আর তা কম-বেশি সকলেরই জানা৷
অতীতে অনেক স্পর্শকাতর মামলার আসামিরা কোর্টে হাজিরা দিতে এসে জন্মদিন ও বিবাহবার্ষিকী পালন করে, যা সম্ভব হয়েছে পুলিশের অসৎ কয়েকজন সদস্যের কারণে৷ অর্থের বিনিময়ে কোর্ট হাজতে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যাপারটা সব সময় ঘটে থাকে৷
এছাড়াও আদালত প্রাঙ্গণে আদালতের কর্মচারী নেতাদের যোগসাজশে অবৈধভাবে মোটর সাইকেল রাখা হত৷ আছে অনেক অবৈধ দোকান৷ এসব কিছুই আদালতের নিরাপত্তার সাথে জড়িত৷
আবার কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার কারণেও আদালতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না বলে মনে হয়৷
অতীতে দেখেছি বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল আদালত৷ জঙ্গিরা বোমা হামলায় চালিয়েছে বেশ কয়েকটি আদালতে, তাতে বিচারকসহ অনেকে প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে অনেকে৷ এসব বিবেচনায় আদালতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটাই কাম্য ছিল৷
বিশেষ করে ঢাকার আদালতে অনেক বড় জঙ্গি ও আসামিদের আনা-নেয়া করা করা হয়৷ ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ অনেক জনাকীর্ণ থাকে৷ একদিনে অনেক মামলার শুনানি হয়৷ কয়েকশ আসামিকে জেল থেকে আদালতে আনা হয়৷ এমন পরিস্থিতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে৷ ফলে আদালতে যথাযথ নিরাপত্তা নেয়া উচিত৷ এই দায়িত্ব পুলিশ বিভাগ ও আদালত কর্তৃপক্ষের৷ কিন্তু সেদিকে তারা নজর দেন না৷
তবে কোন অঘটন ঘটলেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়৷ যেমন দুই জঙ্গি পালানোর পর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের প্রবেশ পথসহ চারপাশে পাহারায় অতিরিক্ত পুলিশ, আদালতের হাজতখানার সামনেও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনি, কয়েদি বহনকারী প্রতিটি প্রিজন ভ্যানের সামনে ও পেছনে পুলিশের পাহারা বসানো হয়৷ মূল গেটে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করাও হচ্ছে৷ জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার পর এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতান্তই লোক দেখানো৷
আমাদের দেশে ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়৷ কিন্তু ঘটনাটি যেন না ঘটে সেটা ভেবে ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ এটা কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা ছাড়া কিছুই না৷
এছাড়াও রয়েছে জবাবদিহির অভাব৷ সার্বিকভাবে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে না৷ জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে৷ দায়িত্বে অবহেলা বা অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য ব্যবস্থা নিয়ে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয় না৷ বড় জোর তাদের অন্যত্র বদলি করা হয়৷ জঙ্গি পালানোর ঘটনাতেও এমনটাই ঘটছে৷ জবাবদিহিতা না থাকলে অঘটন ঘটাই স্বাভাবিক৷
ঢাকার আদালতে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আরেকটি ঘটনা ঘটে৷ গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায় শেষে ঢাকার আদালতের কাঠগড়া থেকে জঙ্গি রাকিবুল আইএস-এর পতাকা ও লোগোর আদলে তৈরি টুপি মাথায় দিয়ে প্রিজনভ্যানে ওঠে৷ এ নিয়ে তখন তোলপাড় হয়৷ আদালত এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ রাকিবুল জানিয়েছিল, ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন তাকে টুপিটা দিয়েছিল৷
এর আগে ২০১৪ সালে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়৷ আগের ঘটনাগুলো প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হলে একই ঘটনা আবার ঘটতো না৷
সর্বশেষ দুই জঙ্গি আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া পর জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেয়ার নিরাপত্তা ও আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা নিয়ে সবাই সচেতন হয়েছে৷ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ অন্যান্য সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ তবে এই ব্যবস্থা হবে সাময়িক৷ কিছু দিন পর নিরাপত্তার এই চিত্র আর থাকবে না৷ আবার সবকিছু আগের মতই ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকবে, যতক্ষণ না আরেকটি অঘটন ঘটবে৷