এলএনজি মহাপরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি: গবেষণা
৯ নভেম্বর ২০২৪গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামে ৪১টি এলএনজি (গ্যাস) ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল বিগত সরকার, যা এখনও বাতিল করা হয়নি৷ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ হলে ওই এলাকার পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনজীবন ক্ষতির মুখে পড়বে৷ বাংলাদেশ বিদেশি মুদ্রা খরচেরও চাপে পড়বে৷ কিন্তু সেটা না করে বাংলাদেশ যদি স্বচ্ছ জ্বালানি বা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যায় তাহলে জনজীবন রক্ষার পাশাপাশি অর্থের সাশ্রয় হবে৷
গবেষণাটির শিরোনাম ‘ব্যয়বহুল এলএনজির বিস্তার: বিদেশিদের এলএনজি সংক্রান্ত স্বার্থ যেভাবে বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি তৈরি করছে'৷ শনিবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, মার্কেট ফোর্সেস এবং ফসিল ফ্রি চট্টগ্রাম৷
‘ব্যয়বহুল এলএনজির বিস্তার' পরিকল্পনায় যা আছে
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৪১টি নতুন এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার৷ ওই কেন্দ্রগুলো থেকে ৩৭ দশমিক চার গিগাওয়াট (জিডাব্লিও) বিদ্যুৎ পাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল, যা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে তার তুলনায় বড়৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই কেন্দ্রগুলোকে সহায়তার জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে এলএনজি আমদানির সুবিধা দেয়া হবে৷ এই এলএনজি প্রকল্প তৈরিতে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে৷ এরমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ৩৬ বিলিয়ন এবং আমদানির কাঠামো তৈরিতে ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে৷
পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে এলএনজি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ২০৪১ সাল নাগাদ প্রতিবছর বাংলাদেশকে এলএনজি আমদানিতে সাত থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে৷ এখন প্রতিবছর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে যা খরচ হয় তার তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হবে৷
পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি
গবেষণায় উঠে এসেছে, চট্টগ্রামে এই এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে বছরে মোট ১৩০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়াবে৷ এটা বাংলাদেশের প্রতিবছর যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন হয় তার ছয়গুণ৷
এই কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে৷ ২৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে পড়বে৷ এরমধ্যে রয়েছে এশিয়ান হাতি, চিতাবাঘসহ নানা প্রাণী৷
একই কারণে এসব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষও ক্ষতির মুখে পড়বেন৷ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকার ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ঐহিত্যবাহী পর্যটন, মাছ ধরা, শুটকি, লবণ চাষ, পান চাষের ওপর নির্ভরশীল৷ তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে৷
কিন্তু গবেষকেরা বলছেন ৩৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বাংলাদেশের পক্ষে ৬২ গিগাওয়াট ‘ক্লিন' বা নবায়নযোগ্য জ্বালনি তৈরি সম্ভব৷ বাংলাদেশে এখন যে গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেগুলো প্রতিস্থাপন করেই তা সম্ভব হবে৷ আর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিস্থাপন করলে তার চারগুণ বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হবে৷
তাদের মতে, বাংলাদেশের ২৪০ গিগাওয়াট সৌর এবং ৩০ গিগাওয়াট বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা আছে৷
প্রস্তাবিত এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সঙ্গে জাপানি বেশ কয়েকটি কোম্পানি যুক্ত আছে৷ যুক্ত আছে মিৎসুই, জেরা, সুমিতামো, মিৎসুবিসিসহ জাপানি ব্যাংক৷ জাইকা, আইইইজে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে বলে জানানো হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে৷
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের সুবর্ণ সুযোগ’
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মার্কেট ফোর্সেসের এশিয়া অ্যানার্জি অ্যানালিস্ট মুনিরা চৌধুরী৷ তিনি জানান ব্যয়বহুল ও দূষণকারী জীবাশ্ম জ্বালানি গ্যাস আমদানির এই পরিকল্পনা থেকে সরে আসার একটা সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য৷ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অন্যায্যভাবে বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশকে দূষণকারী তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে নির্ভরশীল করার চেষ্টা করছে, যা কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর৷ বাংলাদেশের জনগণ দূষিত জীবাশ্ম গ্যাস নয়, বরং পরিচ্ছন্ন, নির্ভরযোগ্য এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও শ্বাস নেওয়ার জন্য সুস্থ বায়ু প্রাপ্য৷ জাপানি কোম্পানি ও অর্থদাতাদের জন্য এটাই বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তর এবং গ্রিড আধুনিকায়নে সহায়তা করার একটি সুবর্ণ সুযোগ৷''
তিনি জানান, এই প্রকল্পগুলোর কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যেমন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘বর্তমানে, বাংলাদেশের জনগণ বিদ্যুৎ খরচের চাপে রয়েছে এবং ব্যয়বহুল আমদানি করা এলএনজি'র ওপর নির্ভরতা অব্যাহত থাকলে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে৷ যখন দেশটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্কটে রয়েছে, এলএনজির উপর ৫০ বিলিয়ন ডলারের এ বিনিয়োগের পরিবর্তে বাংলাদেশ ৬২ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, যা দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিগুণ৷’’
‘মহাপরিকল্পনা' বাতিলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‘জীবাশ্ম জ্বালনি এবং এলএনজির আমদানি দেশের জন্য আর্থিক বোঝা এবং প্রাণ-প্রকৃতির বিনাশের সাথে জড়িত৷ বিগত সরকারের সময়ে এনার্জি সেক্টরে পরিকল্পনা করা হয়৷ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ট্রান্সন্যাশনাল পুঁজির পলিসি উন্নয়নে কাজ করে৷ বিগত সরকার যেই এনার্জি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে তা অনিবার্য ছিল না৷ এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তিগত বিকাশ দামে সস্তা৷ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী৷ বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরকে দিয়ে বিগত সরকারের এই জ্বালানি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে৷ নীতিগত জায়গা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে এই মহাপরিকল্পনা বাতিল করতে হবে৷’’
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার নেই৷ ২০৪১ সাল নাগাদ আসলে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন নেই৷ এলএনজি'র জন্য নতুন কোন অবকাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজন নেই৷''
ইন্সটিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিকস অ্যান্ড ফাইনান্সিয়াল অ্যানালাইসিস এর এনার্জি ফর বাংলাদেশের লিড অ্যানালিস্ট শফিকুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে আমাদের এলএনজির ওপর নির্ভরতা আর বাড়ানো যাবে না৷ আমাদের নিজেদের যে গ্যাস আছে সেটা উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এলএনজির দাম অনেক বেশি৷ আর এলএনজি নির্ভরতা বাড়ালে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়তেই থাকবে৷ পরিবেশ ও জনজীবনের ক্ষতিও বাড়বে৷ এলনজি'র কারণে আমরা অর্থনৈতিক বোঝার মধ্যে পড়ছি৷ আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে৷ আমাদেরকে এনার্জি এফিশিয়েন্সি বাড়াতে হবে এবং গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে৷’’
তার জানান বাংলাদেশে যে দুইটি এলনএনজি স্টেশন আছে তা-ও পুরো সক্ষমতায় ব্যবহার করতে পারছে না৷ বিপরীতে বাংলাদেশে সৌর ও বায়ুর ব্যাপক সম্ভাবনা আছে৷ সরকারকে সেদিকে মনযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি৷
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘‘এই গ্যাস ও এলএনজি প্রকল্পগুলো আমাদের জনগণের সম্পদ দখল করে গড়ে উঠেছে৷ যারা এসব স্থাপনা গড়ে আমাদের সম্পদ দখল করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা দিতে হবে৷''
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, ‘‘জাইকা এবং আইইইজে কর্তৃক প্রণীত ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টার প্ল্যান (আইইপিএমপি) অবশ্যই সংশোধন করা উচিত, কারণ এটি বাংলাদেশকে এলএনজির ওপর নির্ভরশীল করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে৷’’