একটি ভঙ্গুর মানচিত্রের গল্প
২৩ আগস্ট ২০১৯আমার ছোটবেলায় খবরের কাগজ মানেই বুঝতাম প্রথম পাতায় বড় শিরোনাম, ‘আলফার বোমায় মৃত ১৫' বা ‘কূটনীতিক খুন, দায়ী আলফা'৷ আলফা(উচ্চারণের ভিন্নতায় কখনও উলফা) মানে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম৷ সত্তরের দশক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরকারের ঘুম কেড়ে নেওয়া অন্যতম সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল ভারত রাষ্ট্রের বাইরে স্বাধীন আসাম প্রতিষ্ঠা৷
আমার মতোই নব্বইয়ের দশকে আসামে থাকতেন এমন মানুষদের কাছে আলফা ছিল অনেকটা পাড়ার মোড়ের চা-বিক্রেতার মতো, যাকে প্রতিদিন সকালে স্কুল যাবার রাস্তায় একবার দেখতে না পেলে মনে হতো, গোটা দিনটাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে৷ যে দিন শিরোনামে থাকতো না আলফা, গোটা দিনটাই মনে হতো কিছুটা অস্বাভাবিক৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও, আসামের মানুষ আজ প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একটু একটু করে ভুলতে শিখেছে আলফার দৈনন্দিন উপস্থিতি৷ ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে প্রথম পাতায় সবচেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে আলফার খবর থাকলে তা ব্যতিক্রম, স্বাভাবিক নয়৷
কিন্তু মাঝের দুই দশকে কী এমন ঘটে গেল আসাম তথা গোটা উত্তর পূর্ব ভারতে, যাতে করে আলফাসহ আরো বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর স্থান প্রথম পাতা থেকে ‘আঞ্চলিক সংবাদে' পরিণত হলো?
আলফা ও সহিংস নস্টালজিয়া
১৯৭৯ সালে আসামের রাজনীতিতে ইস্যু হয়- ‘বিদেশি'৷ মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে শরণার্থীদের ভিড়৷ জরুরি অবস্থার পর সারা দেশ ভারতীয়ত্বের সন্ধান করছে৷ সেই সময়, আসামের উঠতি অসমীয়া জাতীয়তাবাদ মাটি খুঁজে পায় খিলঞ্জিয়া (আসামের আদি নিবাসী) = ভারতীয়, এই সমীকরণে৷ আসামে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি শরণার্থীরা নাড়িয়ে দিয়েছিল আসামে অসমীয়া-বাঙালির ঐতিহাসিক হিসেব৷ ভোটার তালিকায় সেই অমিল থেকে খিলঞ্জিয়া ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয় ‘বঙাল খেদা' আন্দোলন৷ একই বছর, ১৯৭৯ সালেই জন্ম আলফার৷ আন্দোলনশেষে, ১৯৮৫ সালে ‘বঙাল খেদা'র তৎকালীন নেতৃত্বের এক দল আসামে সরকার গঠন করে৷ এরপরের কয়েক বছর ধরে, গণমাধ্যমে আলফার উপস্থাপনের স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ আসামসহ উত্তর পূর্বের অন্যান্য রাজ্যে বাড়তে থাকে আলফার জনপ্রিয়তা৷
কিন্তু হিসেবে গোলমাল লেগে যায় যখন ১৯৯০ সালে আলফাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয় ভারত সরকার৷ ‘অপারেশন বজরং', ‘অপারেশন রাইনো' রাগিয়ে দেয় আলফা নেতৃত্বকে৷ একের পর এক হাইপ্রোফাইল কূটনীতিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলীদের অপহরণ, খুনের সাথে জড়াতে থাকে তাদের নাম৷ একটা পর্যায়ে আসামে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এসে তলানিতে ঠেকে৷ শুধু তাই নয়, একাধিক বোমা হামলায় সাধারণ জনজীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ এনডিএফবি (ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড) ও আলফার মতো একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের বাড়বাড়ন্ত এই অঞ্চলে ইন্ধন জোগায় রাষ্ট্রবিরোধী চেতনাকে৷ বিদেশি শক্তিদের কল্যাণে এই গোষ্ঠীর হাতে মজুত হয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, বোমা৷ অন্যদিকে, ১৯৯২ পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল হিন্দি-হিন্দু-ভারতীয় সমীকরণ৷ সেই সময় যে ধরণের ‘ভারতীয়ত্বে' জোর দেওয়া হচ্ছিল জাতীয় পর্যায়ে, সেই ভারতীয় চেতনায় স্থান ছিল না আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের৷ স্বাভাবিকভাবেই, কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে জমতে থাকে ক্ষোভ৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে একটা পর্যায়ে এসে কমে যেতে থাকে আলফার গ্রহণযোগ্যতা৷
একদিকে ব্যাপক সহিংসতার কারণে সন্ত্রাসের পরিবেশ, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর চাপ, সব মিলিয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় আলফার গণহারে আত্মসমর্পণ৷ আলফা ভেঙে জন্মায় আরেক দল ‘সালফা' (সরকারের সাথে সংলাপে আগ্রহী সাবেক আলফা সদস্য)৷ আলফার ভেতরের ভাঙাগড়ার মাঝেই ১৯৯১-১৯৯৮ সময়ে আত্মসমর্পণ করেন ৪ হাজার ৯৯৩ জন৷ ২০১৯ সালের হিসেব, মোট ৮ হাজার ৭১৮ আলফা সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে৷ এছাড়া, অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীদের গুলিতে মারা গেছেন বহু আলফা সদস্যেরা৷
বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা আলফা নেতৃত্বের অনেককেই ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ৷ ফলে সেখানেও একটি নিরাপদ স্থান হারিয়েছে তারা৷ আজকের আসামে আলফা সাধারণ নাগরিকের কাছে শুধুই সহিংস নস্টালজিয়া৷ যা ছিল, এখন নেই৷
ভাঙতে ভাঙতে যেখানে শেষ..
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের আর কোন রাজ্য এতবার নিজেকে ভাঙেনি, যত বার ভেঙেছে আসাম৷ ১৯৪৭ সালের আসাম প্রথমবার ভাঙে ১৯৬৩ সালে৷ নাগা গোষ্ঠীর স্বাধিকারকে মর্যাদা দিয়ে জন্ম হয় নাগা রাজ্যের৷ বর্তমান নাগাল্যান্ডেরও রয়েছে আংশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার, যার কারণে নাগাদের রীতি অনুযায়ী পালন করা হয় প্রশাসনিক কাজকর্ম৷ ভাষাগত ভিন্নতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে একে একে জন্মায় মেঘালয় (১৯৭২), মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশ (১৯৮৬)৷ মণিপুর ও ত্রিপুরা কখনোই আসামের এই মানচিত্রের অংশ ছিল না৷ তারা ভারতে যোগদান করে ‘প্রিন্সলি স্টেট' বা রাজত্ব হিসাবে৷ কিন্তু আসাম ভাঙার যে প্রক্রিয়া ১৯৮৬ সালে থেমে গিয়েছিল বলে মনে করেন অনেকে, তা এখন আবার প্রশ্নের মুখে৷
আলফার স্বাধীন আসামের স্বপ্ন আপাতভাবে স্থগিত, কিন্তু নতুন অনেক এমন গোষ্ঠী বর্তমানে আসামে কাজ করছে, যাদের মূল উদ্দেশ্য ভাঙন বা বিচারান্তরে, স্বাধীনতা৷ বোড়োল্যান্ড তো রয়েছেই, অন্যদিকে রয়েছে বাংলাভাষী বরাক উপত্যকার নিজেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলার জোরালো দাবি৷ ওপর থেকে দেখলে, শান্তি ও গণতন্ত্রের জয় হয়েছে আলফার এই প্রাসঙ্গিকতা হারানোর মধ্যে৷ কিন্তু মাঠপর্যায়ে গেলে বোঝা যাবে, ভাঙনের অনেক পথ খোলা৷ হ্যাঁ, সহিংসতার পরিমাণ হয়তো সেই তুলনায় কম, কিন্তু ২০১২ সালের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এটাই শেষ নয়৷
আগামী ৩০ আগস্ট প্রকাশ পাবে আসামের নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকা৷ আশঙ্কা করছেন অনেকে, বাদ পড়বেন কম করে কয়েক লক্ষ মানুষ৷ এই মানুষদের ঠাঁই দেবে না কোনো মাটি৷ ৩১ আগস্ট থেকে যদি এই মানুষরা প্রশ্ন করেন, তাদের জন্য কোন রাজ্য বরাদ্দ, উত্তর দিতে পারবে না গণতন্ত্র৷ হাওয়ায় ভাসছে বরাক উপত্যকার পৃথকীকরণের দাবি৷
ছোটবেলার মতো আমি আজও প্রতিদিন সকালে সেই পুরোনো চা-বিক্রেতার খোঁজে আসামের খবরের কাগজ পড়ি৷ কিন্তু চায়ের দোকানের বদলে ওখানে নাগরিকপঞ্জীর ভূত দেখতে পাই৷