ভ্রান্ত আদর্শকে ভাঙতে হবে আদর্শ দিয়ে
২৩ আগস্ট ২০১৯ফার্মগেট থেকে ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছিলাম৷ হুট করে অস্থিরতা, চাপা আতঙ্ক, দৌড়াদৌড়ি৷ সবার মধ্যে অজানা আশঙ্কা৷ কানে এলো বোমা হামলা৷
নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা আর অজানা উৎকণ্ঠায় ঘটনা পুরোপুরি ঠাহর করতে পারিনি৷ পরে জানলাম, সেদিন দেশের ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ বাদ পড়েছে শুধু মুন্সীগঞ্জ৷ সেই প্রথম জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব এবং তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে পারলো বাংলাদেশ, একটা বড় ধাক্কাও খেলো বৈকি৷
এর আগে রাজশাহীতে বাংলা ভাইয়ের উত্থান নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও তৎকালিন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেসব কথা আমলে নেয়নি৷ বরং মিডিয়ার সৃষ্টি বলে ঘটনা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল৷ সে ঘটনার পর তারাও নড়ে চড়ে বসলো কিছুটা৷ তারপর নানা ঘটনাচক্রে ২০০৬ সালের ২ মার্চ সিলেট থেকে শায়খ আবদুর রহমান ও ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করা হয়৷ আর ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ জেএমবির শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আবদুর রহমান, অপারেশন কমান্ডার আতাউর রহমান সানিসহ ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হয়৷
তারপর বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিলে, জঙ্গিবাদ খুব একটা ছোবল হানেনি বাংলাদেশে৷ কিন্তু ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনকালে আবার নতুন করে মাথা চাড়া দেয় জঙ্গিরা৷ ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীব হায়দারকে৷ শাহবাগ আন্দোলনে শুরু থেকে অংশ নেয়া এই ব্লগার ‘থাবা বাবা' নামে ব্লগ লিখতেন৷ এ ঘটনার পর একেরপর এক ব্লগার, মুক্তমনা লেখক আর প্রকাশকদের হত্যা এবং হত্যা চেষ্টা করে জঙ্গিরা৷ সামনে আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নাম৷ ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামের জঙ্গি সংগঠনটির তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো৷ এখন ততোটা হাঁক ডাক নেই৷ সংগঠনটি মূলত আল কায়েদার অনুসারী৷ তাদের শীর্ষ নেতা দেশের সামরিক বাহিনী থেকে বহিস্কৃত মেজর জিয়া৷ তিনি এখনো পলাতক৷ তাই সংগঠনটিকে আশঙ্কার বাইরে রাখা ঠিক হবে না৷
২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঘটে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা৷ সেদিন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে তিন জঙ্গিকে ময়মনসিংহ আদালতে অন্য মামলায় হাজিরা দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় গুলি ও বোমা ফাটিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেয় হামলাকারী জঙ্গিরা। তিন জঙ্গির মধ্যে ছিলেন মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন সালেহীন ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া বোমারু মিজান। ঘটনার দিন বিকেলে টাঙ্গাইলের সখীপুরে পুলিশের চৌকিতে ধরা পড়ে রাকিব হাসান। রাতে তাঁকে নিয়ে পুলিশ অভিযানে বের হলে তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয় রাকিব। এখনও সন্ধান মেলেনি সালাউদ্দিন সালেহীনের৷ গেল বছরের ৭ আগস্ট ভারতের ব্যাঙ্গালুরু এলাকা থেকে জেএমবির দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গি বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করে ওই দেশের পুলিশ৷
জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছিল ২০১৬ সালে৷ ওই বছরের ১ জুলাই আসে সেই অপ্রত্যাশিত সন্ধ্যা৷ ডিএমপি কমিশনার নিজেই বলেছেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে যে মর্মান্তিক বিয়োগান্ত জঙ্গি হামলা সংঘটিত হয়, সেটি ছিল আমাদের কাছে হঠাৎ একটি বজ্রপাতের মতো। জিম্মিদশা কেমন হতে পারে?-এর আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি, গোয়েন্দাদের গতিবিধি ফাঁকি দিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংস্থা আইএস-এর আদলে কজন যুবক মিলে এই জিম্মিদশার সৃষ্টি করে৷ সারারাত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পর অবশেষে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে অবসান হয় জিম্মিদশার৷ ভয়ংকর সেই হামলায় দেশি-বিদেশি ২২ জন জীবন দিয়েছেন। দুজন ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা৷ আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, সহাবস্থানের ঐতিহ্য; সেখানে এমন হামলা হতে পারে, এটি ছিল চিন্তার বাইরে৷ এই ঘটনার কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেকখানি পিছিয়ে গেছে৷ এতোজন বিদেশিকে হত্যার পর আস্থাহীনতায় পড়ে ভিনদেশি কর্মীরা৷ পদ্মাসেতু আর মেট্রোরেলের কাজ পিছিয়ে গেছে অন্তত দেড় বছর৷
ওইসময় ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল আইএস৷ আক্রমণকারীদের পোশাকও ছিলো আইএস-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ৷ এরপর সিলেটের আতিয়া মহল কিংবা আরো কিছু ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করলেও বাংলাদেশ সরকার সেটা আমলে নেয়নি৷ সরকারপ্রধান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সবাই বলেছেন দেশে আইএস-এর কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্য বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বলেও দাবি করা হয়েছে৷
এরপর দৃশ্যত কিছু সাফল্যও দেখিয়েছে ব়্যাব পুলিশ৷ তবে জেএমবির কার্যক্রম বর্তমানে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের নিষিদ্ধ সংগঠনটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের তথ্য মিলেছে। চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। ২৭ মে মালিবাগে পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলায় একজন পথচারী আহত হন। ২৩ জুলাই রাতে খামারবাড়ী ও পল্টন পুলিশ বক্সে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা দুইটি শক্তিশালী আইইডি যুক্ত বোমা ফেলে রেখে যায়। পুলিশ ঐ দুইটি বোমা নিষ্ক্রিয় করে। এসব ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই মুহূর্তে জঙ্গিদের বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালানোর মতো ক্ষমতা থাকলেও তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের জিনিউজ এক প্রতিবেদনে জানায়, সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস-এর ‘বাংলাদেশ ইউনিট' গত সপ্তাহে আমাক এজেন্সি এবং আইএসপন্থী টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ‘দ্য বেস্ট আউটকাম ইজ ফর পায়াস' শিরোনামে একটি ভিডিও প্রকাশ করে৷ তাতে দেখা যায়, আইএস-এর দুই সদস্য সুইসাইড জ্যাকেট পরে এবং মেশিনগান নিয়ে সংগঠনটির নেতা আবু বকর আল-বাগদাদীর কাছে জিহাদে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷ ভিডিওটিতে আইএস-এর চারজন সদস্য বাংলায় কথা বলেন এবং শেখ হাসিনা সরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ব়্যাবের সমালোচনা করেন৷ তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলছেন, বাংলাদেশে আইএস বলে কিছু নেই, এখানে যারা আসবে তারা বিপদে পড়বে এবং কিছুতেই ঘাঁটি গাড়তে পারবে না৷ ভিডিওতে যারা বাংলায় কথা বলেছেন তাদের শনাক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
এ কথা মানতেই হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আগের তুলনায় বেড়েছে৷ কিন্তু তাঁদের সক্ষমতার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, অপরাধের ধরন এখন পাল্টে যাচ্ছে৷ জঙ্গিবাদ নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা হয় আমার৷ তাঁরা জানান, জঙ্গিবাদে জড়িতরা আগের মতো আস্তানা করে থাকেন না৷ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করছে৷ এ কারণে এই এনক্রিপ্টেড ডেটা থেকে তথ্য উদ্ধার করাটা পুলিশের পক্ষে কখনো কখনো বেশ কঠিন৷ তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৌশল পাল্টানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতা আরো বাড়াতে হবে৷
জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়৷ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স নীতি' গ্রহণের কথা জানিয়েছের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি৷ এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন ধর্মীয় শিক্ষাগুরুদের৷ তবে আমাদের সংকট হলো, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকার কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা যতোটা দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা মিইয়ে যায়৷ এ জায়গা থেকে আসলে বের হয়ে আসা উচিত৷
ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েই জঙ্গিরা তরুণদের ভুল পথে পা ফেলতে বাধ্য করছে৷ ফলে এই অপব্যাখ্যার বিপরীতে সঠিক ব্যাখ্যাটি অনেক বেশি প্রচার করা দরকার৷ জঙ্গিবাদ নির্মূলে সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া আর কোনো পথ নেই৷ যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাদের কাছে এটি একটি আদর্শ৷ ভ্রান্ত হলেও সেই আদর্শে তারা বিশ্বাসী৷ ফলে সেই আদর্শকে আদর্শ দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে৷