বিজয় মালিয়া, নীরব মোদী এবং মেহুল চোকসি। এই তিন শিল্পপতি একসময় দিনের পর দিন খবরের কাগজের শিরোনামে থাকলেও এখন তাদের নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। বিজয় মালিযার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কিংফিশার এয়ারলাইন্সের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। ২০১৬ সালে তিনি ভারত ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। তারপর থেকে ভারত তাকে আর্থিক অপরাধের জন্য দেশে ফেরাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার আট বছর পরেও বিজয় মালিয়াকে ভারত হাতে পায়নি।
নীরব মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকে ভুয়া লেটার অফ আন্ডারটেকিং (এলওইউ) দিয়ে ১৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার জালিয়াতি করেছেন। তার সঙ্গে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তার স্ত্রী, মামা মেহুল চোকসি, তার আরেক আত্মীয় এবং ব্যাংকের কিছু কর্মী। সিবিআই ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে ছয় হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগ আনার কিছুদিন আগে তিনি সপরিবারে যুক্তরাজ্য চলে যান। তারপর তাকেও ভারতের হাতে তুলে দেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। ছয় বছর পরেও ভারত তাকে হাতে পায়নি।
নীরবের মামা মেহুল চোকসির কাহিনি তো আরো চমকপ্রদ। তিনি ২০১৭ সালে অ্যান্টিগা ও বারবুডার নাগরিকত্বর জন্য আবেদন করেন এবং পেয়ে যান। হীরে ব্যবসায়ী ও গীতাঞ্জলি গ্রুপের মালিকের বিরুদ্ধে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে জালিয়াতি-সহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে তিনিও ভারত থেকে চলে যান অ্যান্টিগাতে। ২০২১ সালে তিনি অ্যান্টিগুয়া থেকে উধাও হয়ে য়ান। ডোমিনিকান রিপাবলিকে বেআইনিভাবে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়েন। আবার অ্যান্টিগুয়াতে ফিরে আসেন। ছয় বছর পরেও তাকে দেশে ফেরাতে পারেনি ভারত।
এই তিনজনের নাম এজন্য নিতে হচ্ছে যে, তারা সকলেই ভারতের সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত না দিয়ে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ। আট বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বিজয় মালিয়া এবং নীরব মোদী একের পর এক মামলা হেরেছেন। তবু তাদের দেশে ফেরানো যায়নি। যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী ২০২৩ সালের অগাস্টে এমন কথাও বলেছেন, ভারত থেকে বিচারের মুখোমুখি না হয়ে যারা পালিয়ে এসেছেন, তাদের যুক্তরাজ্যে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সরকারি প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় তো লাগে। তারপরেও এক বছরের বেশি সময় চলে গেছে। কিন্তু তারা এখনো যুক্তরাজ্যে। কবে ফিরবেন কেউ জানে না।
একের পর এক ঋণখেলাপি
ভারতের ব্যাংকগুলির নন পারফর্মিং অ্যাসেট বা এনপিএ-র পরিমাণ শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে। প্রথমে জানা দরকার এই নন পারফর্মিং অ্যাসেট বস্তুটি কি? কোনো ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে ঋণ দিলো বা অ্যাডভান্স দিলো, তারপর শোধ দেয়ার ৯০ দিন কেটে যাওয়ার পরেও তা শোধ হলো না, তখন তাকে নন পারফর্মিং অ্যাসেট বলে। ২০১৯ সালে ভারতের সরকারি ব্যাংকগুলির এই নন পারফর্মিং অ্যাসেটের পরিমাণ ছিল, সাত দশমিক তিন ট্রিলয়ন টাকা। ট্রিলিয়ন মানে একের পর ১২টি শূন্য কোটি টাকা। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক চার ট্রিলিয়ন কোটি টাকা।
কী করে এনপিএ-র পরিমাণ কমলো? কিছু টাকা উদ্ধার হয়েছে। ফিনান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত লোক আদালতে প্রায় চার লাখ মামলা করা হয়েছে। সেখানে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন টাকা। সেখানে উদ্ধার হয়েছে ২১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে যেটা হয়েছে, তা হলো, গত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের ব্যাংকগুলির ১০ লাখ কোটি টাকার ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে।
এটাও ঠিক, ভারতে প্রচুর কোম্পানি বা ব্যক্তি আছে, যারা ব্যবসা করার জন্য, শিল্প করার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসা মার খেয়েছে। শিল্প ডুবেছে। তখন ঋনও ডুবেছে। তখন কিছু ক্ষেত্রে সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংক কিছু টাকা তুলেছে। কিছু ক্ষেত্রে টাকা রাইট ইফ করতে হয়েছে। তাছাড়া ঋণ দেয়ার পরই তো প্রথম থেকেই তা এনপিএ হয়ে যায় না। যতদিন কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে, ততদিন তো ব্যাংক সুদবাবদ রোগজারও করছে। ফলে এর মধ্যে অনেক হিসাবের বিষয়ও আছে।
আসলে এই ঋণ দেয়াটা তো ব্যাংকেরও একটা ব্যবসা। অন্য যে কোনো ব্যবসার মতো এখানেও ঝুঁকি আছে। ঋণ দিলে তার একশ শতাংশ উদ্ধার হবে এমনটাও নয়। এটা ধরে রেখেই ব্যাংক এগোয়। কিন্তু বিতর্ক দেখা দেয় এবং বিপদ হয়, যখন রাজনৈতিক প্রভাবে পড়ে, যোগসাজশ করে, জালিয়াতির মধ্যে পড়ে সরকারি ব্যাংক ঋণ দেয়। তখন সেই টাকা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই ব্যারামে কত ব্যাংকের যে সর্বনাশ হয়েছে তা বলার নয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সরকারি ব্যাংক মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
ভারতের ব্যাংকি ব্যবস্থায় দুটি দুর্বলতার কথা বলা হয়। প্রথমটি অবশ্যই বিপুল পরিমাণ এনপিএ এবং দ্বিতীয়টি হলো গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক প্রত্যাশামতো পৌঁছায়নি। তবে তারপরেও ভারতীয় ব্যাকিং ব্যবস্থার একটা শক্তি আছে। এই বিপুল এনপিএ-র ধাক্কা, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ সত্ত্বেও তা এখনো শক্ত জমির উপরে আছে।
কিন্তু এইভাবে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদীরা যদি ভারত থেকে পালিয়ে চলে গিয়ে বছরের পর বছর ভারতীয় বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে যেতে পারেন, তাহলে সেটাও তো খুব বড় বিপদ। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই দুর্বলতা তো কাটাতেই হবে।