ইউটিউবে হিন্দুত্ববাদীদের জোরালো প্রচার
২৫ নভেম্বর ২০১৮জনসভা কিংবা বাড়ির দরজায় ঘুরে ঘুরে প্রচার এখন সাবেকি ধারণা৷ এখন অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে৷ বিপণনের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য শিল্পীরা তাঁদের অ্যালবাম প্রকাশ করছেন ইউটিউবে৷ একে হাতিয়ার করে গানের মাধ্যমে চলছে প্রচার৷ ইউটিউবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন লক্ষ্মী দুবে, সন্দীপ চতুর্বেদি, সঞ্জয় ফৈজাবাদি, নরোত্তম রঙ্গের মতো শিল্পীরা৷ এঁদের সংগীত মূলত প্রচারমূলক৷ প্রত্যেকেই হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে গান বেঁধেছেন৷ এই গানে কখনো ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার দাবি উঠছে, কখনো বলা হচ্ছে ইতিহাস থেকে মোঘল সম্রাট বাবরের নাম মুছে ফেলতে হবে৷ কখনো গানে নিশানা করা হচ্ছে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রকে৷
সংগীত উৎকর্ষের বিচারে এগুলি কতটা মানোত্তীর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে৷ তবে তার থেকেও বড় প্রশ্ন উঠছে গানের বক্তব্য ঘিরে৷ এই গানগুলিতে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ সামনেই লোকসভা নির্বাচন, তার আগে এই প্রচারের পিছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘অতীতে আমরা এক ধরনের তাত্ত্বিক হিন্দুত্ব দেখেছি৷ এখন দেখছি কর্পোরেট হিন্দুত্ব৷ এখানে রাজনীতিও পণ্য হয়ে উঠেছে৷ তারই অঙ্গ হিসেবে সোশাল মিডিয়ায় এমন প্রচার চালানো হচ্ছে৷''
যদিও শিল্পীদের বক্তব্য, তাঁরা নিজেদের ধর্মের প্রচার করছেন৷ লক্ষ্মী দুবে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আমার ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করছি৷ এতে অন্যায় কী আছে? রামের গান গাইতে আপত্তি থাকার কথা নয়৷ আমি চাই হিন্দুদের মধ্যে একতা গড়ে উঠুক৷'' কেন ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে এই গান শোনানোর কথা ভাবলেন তিনি? লক্ষ্মী বলেন, ‘‘অনেকগুলি বিষয় আমি দেখেছি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময়৷ মসজিদ, মাদ্রাসায় অস্ত্র মজুত রাখা হচ্ছে৷ হিন্দু মেয়েদের ক্ষতি করা হচ্ছে৷ কারো বন্দেমাতরম্ বলতে আপত্তি৷ তাই মনে হয়েছে, দেশভক্তির প্রচার করা দরকার৷''
এই অভিযোগ কতটা সত্যি? রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন শীর্ষকর্তা ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আমি এ ধরনের কোনো অভিযোগের কথা শুনিনি৷ আমার সহকর্মীরাও শুনেছেন বলে জানি না৷ অন্য রাজ্যের কথা বলতে পারব না৷ তবে এটাও ঠিক, আমি জানি না বলে অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যে, সেটা বলতে পারব না৷'' বছর তিনেক আগে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে এমন মাদ্রাসার খোঁজ মেলে, যাকে কেন্দ্র করে জঙ্গি গতিবিধি চলছিল৷ এ ব্যাপারে নজরুলের বক্তব্য, ‘‘এমন অনেক মাদ্রাসা রয়েছে, সেখানে শুধু ইসলামি ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়৷ এগুলি সরকারি স্বীকৃতিহীন খারিজি মাদ্রাসা৷ তবে শুধু মাদ্রাসা কেন, স্কুলেও অস্ত্র উদ্ধারের দৃষ্টান্ত রয়েছে৷''
মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রচারে লক্ষ্মীকে দেখা গেলেও তাঁর দাবি, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি গান শোনাচ্ছেন না৷ বছর তিরিশের এই নারীর বক্তব্য, ‘‘বিজেপি হিন্দুদের হিতৈষী৷ তাই ওদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি৷ যদি ওরা কখনো হিন্দুদের বিরুদ্ধে কাজ করে, তখন ওদের বিপক্ষেই থাকব৷ রাজনীতি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই৷''
গান নিয়ে যে বিতর্কই থাক, ইন্টারনেটে তা বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে৷ লক্ষ্মীর কোনো কোনো গান ইতিমধ্যে ২৫ লক্ষের বেশি মানুষ অনলাইনে শুনেছে৷ বজরং দলের কর্মী অযোধ্যার সন্দীপ চতুর্বেদির কট্টর জাতীয়তাবাদী গানের দর্শক কয়েক লক্ষ৷ সামরিক পোশাক পরে দর্শকদের সামনে হাজির হওয়া দিল্লির সঞ্জয় ফৈজাবাদি তাঁর গানে প্রতিবেশী পাকিস্তান, চীন কিংবা জঙ্গি হাফিজ সৈয়দকে আক্রমণ করছেন৷ প্রচুর মানুষ এই ভিডিও দেখছে৷ সংগীত হিসেবে উন্নত না হলেও কেন জনপ্রিয় এসব গান? উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সর্বভারতীয় স্তরে কর্পোরেট হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে৷ সেই শূন্যতা কাজে লাগাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা৷ তরুণ সমাজ এখন কাজের অভাবে হতাশাগ্রস্ত৷ কোনো বিকল্প না থাকায় তাদের এই প্রচার ছুঁয়ে যাচ্ছে৷''
অনেকেই মনে করছেন, তথাকথিত উদারপন্থিদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রচার সফল হচ্ছে৷ বাংলাতেও কি তার প্রভাব পড়বে? কাজি নজরুল ইসলাম, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীরা জনচেতনার গানে এ রাজ্যের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন৷ সেই ধারায় পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী শুভেন্দু মাইতি গেয়েছিলেন ‘মৈনুদ্দিন কেমন আছো?'৷ তিনি বলেন, ‘‘বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, দিশাহীন৷ তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না৷ আমি যদি আরেকটা মৈনুদ্দিন লিখে ইউটিউবে দিই, সে গান কতজন শুনবে? বামপন্থিরাই তো গান শোনে না৷ প্রতিবাদ করতে হবে মাঠে নেমে, একজোট হয়ে৷'' তবে গানের পাল্টা গানকেই হাতিয়ার করার পক্ষপাতী আরেক শিল্পী পল্লব কীর্তনিয়া৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পাল্টা গান লিখতে হবে৷ প্রচার করতে হবে৷ শুধু গান কেন, নাটকও হাতিয়ার হতে পারে৷ উদারপন্থিরা সংখ্যালঘু, অধিকাংশ মানুষের মনে ধর্ম বাসা বেঁধে থাকে৷ তাই রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালন করছি৷ আমরা কিন্তু বলছি না, রামনবমীর উন্মাদনার বিরুদ্ধে আমাদের চেতনার সংস্কৃতি গড়তে হবে৷''
বছর দুয়েক ধরে পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী ঘিরে ব্যাপক উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এই আয়োজনে গেরুয়া শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ তার পাল্টা হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস ব্যাপকভাবে হনুমান জয়ন্তী পালন করেছে, যা এ রাজ্যে কখনো দেখা যায়নি৷ এটা কি কট্টর হিন্দুত্বকে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবিলার প্রকাশ নয়? পল্লবের সুরেই অধ্যাপক উদয়ন বলেন, ‘‘তাত্ত্বিক হিন্দুত্বকে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করার সুযোগ ছিল৷ কিন্তু কর্পোরেট হিন্দুত্বকে সর্বভারতীয় স্তরে মোকাবিলা করার পথ বিরোধীরা খুঁজে পাচ্ছে না৷ তাই বিজেপির পাল্টা হিসেবেই রাহুল গান্ধী এখন মন্দিরে মন্দিরে যাচ্ছেন৷ তিনিও হিন্দুভোট হারানোর ভয় পাচ্ছেন৷''