কেন বদলাচ্ছে শহরের ‘মুসলিম' নাম?
১৩ নভেম্বর ২০১৮বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আদিত্যনাথের দল, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরের নাম বদল করছে৷ গত সপ্তাহে, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এলাহাবাদের নাম বদলে ‘প্রয়াগরাজ' ও ফৈজাবাদকে বদলে ‘অযোধ্যা' করার ঘোষণা করেন৷ এর কারণ হিসাবে তাঁরা দেখিয়েছেন ইতিহাসকে৷
বিজেপির মতে, ব্রিটিশ দখলের আগেই, এই শহরগুলির মূল হিন্দু নাম বদলে মুসলিম নাম করা হয়৷ ১৮৫৭ সালের পর থেকে সেই নামগুলি বদলে ইংরেজি নাম রাখে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার৷ এই ইতিহাসের চাকা উলটো ঘোরাতে চেয়েই নাম বদলে ব্যস্ত বর্তমান বিজেপি সরকার৷
কিন্তু নাম বদলের এই হিড়িক শুধু উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ নেই৷ অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও শুরু করে দিয়েছেন রাস্তা, এয়ারপোর্ট বা শহরের নাম বদল করা৷ গুজরাটে আহমেদাবাদের নাম বদলে হয়েছে কর্ণাবতী৷ এদিকে, দক্ষিণের রাজ্য তেলেঙ্গানার বিজেপি সাংসদ রাজা সিং ইতিমধ্যে হায়দ্রাবাদের নতুন নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছেন ‘ভাগ্যনগর'৷ এমনকি তাজ মহলের জন্য বিশ্বখ্যাত শহর আগ্রার নাম পরিবর্তন করে ‘অগ্রভান' বা ‘অগ্রওয়াল' করারও কথা শোনা যাচ্ছে৷ মুজফফরনগরকে লক্ষ্মীনগর করার প্রস্তাবও উঠে এসেছে এর মধ্যে৷
এখানে লক্ষণীয়, যে শহরগুলির নাম পরিবর্তন করার দাবি উঠছে, সেই প্রত্যেকটি নামেরই রয়েছে মুসলিম শিকড়৷
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
ফৈজাবাদের নাম ‘অযোধ্যা' ঘোষণা করার পর আদিত্যনাথ বলেন, ‘‘অযোধ্যা আমাদের কাছে সম্মান, গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক৷''
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই নামবদলের পেছনে রয়েছে আসন্ন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরিকল্পনা৷ এই নামবদল আসলে ভারতের গোঁড়া হিন্দু ভোটকে সংগঠিত করার উপায়৷ শহরের নামবদল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সাধারণ ঘটনা হলেও, ভারতের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দেশের ‘হিন্দুকরণ'-এর প্রক্রিয়া৷
সমাজতাত্ত্বিক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই নামবদল আসলে দেশের বহুমুখী সত্ত্বার বিরোধী৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি দেশের গোঁড়া হিন্দু ভোটারদের তোয়াজ করতেই এমন কাজ করছে৷ কিন্তু এসবের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা পৌঁছাচ্ছে, তা সমস্যাজনক৷''
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর মূল লক্ষ্য ভারতকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু-মুক্ত একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্রে' পরিণত করা৷ সমালোচকেরা মনে করেন, এই ধারণা দেশের সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে বৈরি মনোভাব সৃষ্টি করে, যা নামবদলের রাজনীতির মধ্যেও সমানভাবে বিরাজমান৷
নতুন দিল্লীর অর্থনীতিবিদ পরীক্ষিৎ ঘোষের মতে, এই নামবদল আসলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা সরকারের গত চার বছরের ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরানোর কৌশল৷
শুধু যে গবেষকেরা এমন মনে করছেন, তা নয়৷ অনেক রাজনীতিকরাও এই পদক্ষেপের বিরোধী৷
লোকতান্ত্রিক জনতা দলের নেতা, শারদ যাদবের ধারণা, বিজেপির এই কাজ ভারতের বহুত্বকে ক্ষুণ্ণ করে৷ যে বহুত্ব স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট হয়ে এসেছে, তার চরম বিরোধী বিজেপির এই মুসলিম নাম বদলের কার্যকলাপ, বলে জানান তিনি৷
বহুত্বের সাথে আপোষ
নামবদলের কাজ ভারতে বেশ অনেক বছর ধরেই চলছে৷ স্বাধীনতার পর, ব্রিটিশ প্রভাব থেকে বেরোনোর জন্য অনেক শহরের নাম বদলানো হয়৷ ইংরেজি নামের বদলে জায়গা করে নেয় বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠী দ্বারা অনুপ্রাণিত নাম৷
এ বিষয়ে শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘গত ৫০ বছরে অনেক বার নাম বদল করা হলেও এবার তা করা হচ্ছে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে৷''
কিন্তু, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা৷
আরএসএস সদস্য, রাঘব আওয়াস্থির মতে, ‘‘আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির একতা ও অখণ্ডতার পক্ষে৷হিন্দু রাজা ‘ভরত'-এর আদর্শ মেনে দেশের সাংস্কৃতিকঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য৷''
হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কৈফিয়ত দেওয়া সত্ত্বেও ভারতের একাংশে এই নামবদলের সমালোচনা থেকে যাচ্ছে৷ এর কারণ হতে পারে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সহিংসতা৷ ২০১৪ সাল থেকে একাধারে বেড়েছে ‘গো-রক্ষা'র নামে সংখ্যালঘু মুসলমান হত্যার ঘটনা৷
এভাবেই,অতি-ডান চরমপন্থিদের উত্থানের ফলে দেশে বাড়ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গুরুত্ব৷
মুরলি কৃষ্ণন/এসএস