একের পর এক সফল সমাবেশ করে রাজনীতির মাঠে আবার সরব হয়ে উঠে বিরোধীদল৷ বাধা অতিক্রম করে সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ক্ষমতাসীন দলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷
ঢাকার বাইরে প্রতিটি সমাবেশ ঘিরে ছিল এক ধরনের ভয় ও আতঙ্ক৷ ৫ নভেম্বর বরিশালে বিভাগীয় গণসমাবেশকে ঘিরে সমাবেশের আগের রাতে আওয়ামী লীগ আকস্মিক শহরে মিছিল করলে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিএনপিকে ‘দেখিয়ে দেয়ার' বক্তব্যে ছিল পরোক্ষ হুমকি৷ নেয়া হয় পালটা রাজনৈতিক কর্মসূচিও৷
ঢাকার বাইরের সমাবেশগুলো সফলভাবে করলেও ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা৷ বিএনপির কিছু নেতার প্রধানমন্ত্রী ও সরকারবিরোধী বক্তব্য আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেয়৷ সরকারদলীয় নেতাদের পালটা বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনিশ্চয়তা পরিণত হয় শঙ্কায়৷ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘খেলা হবে'র মধ্যে ছিল বড় বার্তা৷
অনেকটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করা বিএনপি জন্য অনেক কঠিন৷ সরকারি দল সহজে তা করতে দেবে না৷ সামনে চলে আসে সমাবেশের ভেন্যু৷ বিএনপি আগে থেকেই নয়া পল্টনে সমাবেশের আবেদন করে৷ কিন্তু তাদের সেখানে অনুমতি না দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়৷ বিএনপি তাতে রাজি না হয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে রাস্তায় সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়৷ এরপর কী ঘটেছে সেখানে, তা সবার জানা৷ পুলিশ রাস্তা থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বলপূর্বক উঠিয়ে দিতে সংঘাতের সৃষ্টি হয়, একজন গুলিতে নিহত হয়, আহত হয় অনেকে৷ বিএনপির শীর্ষ অনেক নেতা এখন জেলে৷
এই ঘটনার একটি ভিন্ন প্রেক্ষিত রয়েছে৷অতীতে আমরা দেখেছি বিরোধীদল আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে হরতাল বা সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে৷ ফলে সরকার ও পুলিশ চড়াও হয় এবং অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ কিন্তু বিএনপির সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ৷ তাছাড়া গত তিন মাসে তারা নয়া পল্টনে ১১টি সমাবেশ করেছে৷ সেসময় পুলিশ বাধা দেয়নি, আর বিএনপিও গাড়ি ভাঙচুর করেনি৷ তাই আরেকটি সমাবেশ করতে দিলে সরকারবিরোধী বক্তব্য ছাড়া বিএনপির আর কিছু করার ছিল না৷ কিন্তু তারপরেও সরকার-পুলিশ তা করতে দেয়নি৷
অতীতের অনেক রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে সরকার ও বিরোধীদল দুপক্ষের কারণে৷ সর্বশেষ ঘটনার জন্য দায় মূলত সরকারি দলের৷ এই ঘটনার পর একটি বিষয় স্পষ্ট আর তা হলো, আওয়ামী লীগ কিছুতেই বিএনপিকে দাঁড়াতে দিতে চায় না৷ রাজনীতির অধিকার যেন শুধু সরকারি দলের, অন্য কারো সেই অধিকার নেই৷
সরকারের নীতি হলো ‘জোর যার মুল্লুক তার'৷ এখানে সরকার যা বলবে তাই হবে, অন্যদের তাই মানতে হবে৷ এটা আমাদের দেশের রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতি৷ ক্ষমতাসীন দল সকল অধিকার ভোগ করবে, অন্যদের অধিকার বঞ্চিত করা হবে৷ বিরোধীদলের কর্মসূচি, বিরোধী মতকে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেনি৷ আর এই অবস্থা ঘনীভূত হয়েছে গত এক দশকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে৷ এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যেন কোনো বিরোধী শক্তি সংগঠিত হতে না পারে৷ রাজনীতির ময়দান থাকবে পুরোপুরি সরকারি দলের দখলে৷
বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুসাশন, আইনের শাসন, রাজনীতির চর্চা ও সহিষ্ণুতা বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ একধাপ এগোলে দুইধাপ পিছিয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে অবস্থা বানরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠার গল্পের বিপরীত৷ বানর এক সময় বাঁশের উপরে উঠতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে৷
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ ক্ষমতার গদি দখলের লড়াইয়ে তাই বার বার সহিংসতার পথবেছে নেয়া হচ্ছে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না৷
বাংলাদেশ আবারও সেই ‘পয়েন্ট অফ নো-রিটার্ন'-এর দিকেই ধাবিত হচ্ছে৷ নয়া পল্টনের ঘটনা ও ঘটনা পরবর্তী বিএনপির শীর্ষ নেতাদের আটক যেন সেই বার্তাই দিচ্ছে৷
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার থাকে৷ শুধু রাজনৈতিক উদেশ্যে কোনো ব্যক্তি বা দলের সভা-সমাবেশ বন্ধ করা বা অগণতান্ত্রিকভাবে অধিকার হরণ করলে বা শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দিলে এর পরিণতি ভালো হয় না৷ কেননা, স্বাভাবিক উপায়ে সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ না করতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলো সহিংস পন্থা বেছে নেয়৷ যার ফল কী হয় তা অতীতে বাংলাদেশ দেখেছে৷