1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাঙালিদের হয়ে লিখে যিনি হুমকির মুখে 

২৫ জুলাই ২০১৮

কলকাতার একটি দৈনিকে কলম ধরে রাষ্ট্রের কোপে পড়েছেন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য৷ তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে এফআইআর করা হয়েছে৷ চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা ও হুমকি৷

https://p.dw.com/p/322QH
Indien Kolkata Tapodhir Bhattacharjee
ছবি: DW/Payel Samanta

অসমে ‘বাঙালি খেদাও' অভিযানের বিরুদ্ধে সরব তপোধীর ভট্টাচার্য৷ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকেই তিনি কলকাতার একটি দৈনিকে ভারতের অসম রাজ্যের বাঙালিদের অসহায় অবস্থার কথা লিখেছিলেন৷ লেখাটির অপব্যাখা করে প্রাক্তন উপাচার্য, তথা শিলচরের ‘নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় সমিতি'র সভাপতি তপোধীরের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে৷ এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশিষ্ট বাঙালিরা৷ সার্বিক পরিস্থিতি জানতে তপোধীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷

ডয়চে ভেলে: অসমে বাঙালিদের ভবিষ্যৎ কী?

তপোধীর: এর উত্তর দেওয়ার আগে পরিপ্রেক্ষিতটা জানা দরকার৷ অসমে বাঙালিদের ভবিষ্যৎ সেদিনই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, যখন রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদোলোই শিলংয়ে প্রথম অধিবেশনে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, ‘‘এখন আর বাঙালিরা ইচ্ছে করলেও অসমীয়ারদের উপর কোনো দখলদারি কায়েম করতে পারবে না৷ এখন থেকে অসমের সমস্ত দায়ভার অসমীয়াদের উপর বর্তাবে৷'' স্বাধীনতার বছরেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাঙালিরা এখন যদি এ রাজ্যে থাকতে চান, তাহলে থাকতে হবে অসমীয়াদের প্রভুত্ব স্বীকার করেই৷''

সেই ভাবনার কোনো প্রতিফলন কি এখন দেখা যাচ্ছে?হ্যাঁ, তাই তো হচ্ছে৷ ২০১৭ সালের অসমকে দেখুন, গুয়াহাটির রাজপথে অসমীয়া ভাষায় শোনা যাচ্ছে, বাঙালির আস্ফালন চলবে না৷ প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর কথার সুরে সেখানে বলা হচ্ছে, আসামে থাকতে গেলে অসমীয়াদের প্রভুত্ব মানতে হবে৷ গণতান্ত্রিক দেশে প্রভুত্ব কথাটা বা প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক আসছে কোথা থেকে? বাঙালিসহ বোড়ো, কার্বি, মিশিং, রাভা, মাড় ইত্যাদি সব উপজাতি মিলে একটা বহুস্বরিক অসম তৈরি করেছে৷ অসমীয়ারা সংখ্যাগুরু৷ তাই তাঁদের কিছু সুবিধা থাকবেই৷ কিন্তু তার মানেই কি সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করা! এখানেই আধিপত্যবাদ আসছে৷ গোটা পৃথিবীতে আজ যে দক্ষিণপন্থি পুনর্জাগরণের হাওয়া উঠেছে, তাতেই অসমিয়া আধিপত্যবাদ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে৷

রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালির নাম কেটে ফেলা হচ্ছে, তা আধিপত্যবাদ ছাড়া আর কিছুই না: তপোধীর ভট্টাচার্য

রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালির নাম যে কেটে ফেলা হচ্ছে, তা আধিপত্যবাদ ছাড়া আর কিছুই না৷

অসমে নাকি এখন বাঙালিদের বিদেশি তকমাও দেওয়া হচ্ছে?

আসামে জাতিবিদ্বেষী ধ্যানধারণা থেকে এখন বিদেশি শব্দটা প্রয়োগ করা হচ্ছে বাঙালিদের ক্ষেত্রে৷ বিদেশি কথাটা আসছে কী করে? ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগে অখণ্ড ভারতের একটি অঞ্চল থেকে আরেকটি অঞ্চলে লোকজন এলে তাকে কী করে বিদেশি বলা যায়? যে অঞ্চল থেকে এসেছে, বা যে অঞ্চলে এসেছে, সেটা অখণ্ড ভারতের অংশ৷ সেটা নিয়ে অপপ্রচার চলছে, বাংলাদেশিরা অসমের দখল নিয়েছেন৷

আবার দেখুন, অসমে ৩ কোটি ১২ লাখের মধ্যে অসমীয়াদের সংখ্যা দেড় কোটি৷ বাকি ৯০ লক্ষ বাঙালি৷ তাহলে আসামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-জনবিন্যাস কী করে বিপন্ন হচ্ছে সংখ্যালঘু বাঙালিদের জন্য? এই গত ৩০-৪০ বছরের অবস্থান দেখুন, এই সময়টা নানা অজুহাতে বাঙালিবিরোধী অভিযান তুঙ্গে উঠেছে৷ এই সময়ে অসমীয়া সাহিত্য-চলচ্চিত্র, শিল্পকলা-নাটক যেভাবে জাতীয় স্তরে বা আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নত হয়েছে, বাঙালিরা অসমীয়া সংস্কৃতি গ্রাস করলে তা কি সম্ভব হতো?

অসমের সাধারণ মানুষ এই বাঙালিবিরোধী অ্যাজেন্ডায় কোন অবস্থানে রয়েছে?

অসমীয়া দিনমজুর, কৃষক বা বাঙালি কৃষক বা দিনমজুরে তফাত নেই৷ তফাত হয় মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণীতে৷ সুবিধা ভোগের জন্য পারসিভ ডেঞ্জার (বিপদের অনুমান) সিন্ড্রোমে ভোগেন এলিটরা৷ বিপদ নয়, বিপদের অনুমান৷ তাতেই সমস্যা৷ এই বোধ হয় আমাদের সবকিছু কেড়ে নিলো, আমাদের মেরে ফেললো৷ এই আতঙ্কই পারসিভ ডেঞ্জার সিন্ড্রোম৷

আজকাল আমার মনে হয়, দেশভাগের সময় আমাদের পূর্বজরা এক কথায় যদি না পালিয়ে আসতেন, ভালো করতেন৷ যা আসলে ঘটেছিল, তার থেকে পারসিভড ডেঞ্জার ছিল বেশি৷ তাঁরা যদি দাঁড়িয়ে লড়াই করতেন, তাহলে ভাল হতো৷

ঠিক এই পারসিভড ডেঞ্জারের জন্যই রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিতে বাঙালিদের নাম কাটা যাচ্ছে৷ আধিপত্যবাদই চেপে ধরছে আধিকারিকদের হাত৷ এর পেছনে আরেকটা রাজনৈতিক কারণও আছে৷ প্রতিটি নির্বাচন চক্র থেকে যদি বিশেষ কিছু লোককে বাদ দেওয়া যায়, তাহলে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা ক্ষমতা দখলের জন্য এগোতে সুবিধা পাবে৷ কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতো তাঁরা সব গুছিয়ে নিচ্ছেন৷

রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে কী বলবেন?

৩১ ডিসেম্বর,২০১৭-এর প্রথম খসড়ায় দেখলাম আমার বা আমার পরিবারের নাম নেই৷ এমনিই বাদ হয়ে গিয়েছে! ভিত্তিহীন দলিলের উপর নাগরিক পঞ্জি তৈরি হচ্ছে৷ তাতে সচেতনভাবে বাঙালিদের নাম বাদ৷ চূড়ান্ত খসড়ায় সেই তালিকা থেকেও বহু নাম বাদ যাবে৷  

তা-ও আমরা অপেক্ষা করছি ৩১ শে জুলাইয়ের জন্য৷ যতই দুঃখ থাক, ক্ষোভ থাক, আবেদন করার সুযোগ থাকলে আবেদনও করবো৷ কিন্তু যাঁরা অতি সাধারণ মানুষ, তাঁরা তো এসব কিছু বোঝে না৷ তাঁদের জন্য কথা বলতে হবে৷ গণতান্ত্রিক দেশে আমার দায়িত্বজ্ঞান, মূল্যবোধ তাই বলে৷ 

আর এনআরসি-র সিস্টেমের মধ্যে সম্ভবত কিছু ত্রুটি বা বিচ্যুতি আছে৷ আমাদের সেটা দেখাতে হবে৷ আমরা চাইছি শুদ্ধ এনআরসি হোক৷ সমস্ত বৈধ ভারতীয়র নাম যুক্ত হোক৷ বৈধ ভারতীয় বলতে ভারতের অখণ্ড ভারতে্র সন্ততির কথাই বলছি৷

এই পরিস্থিতিতে অসমের আমবাঙালিদের অবস্থান কিরকম?

এই প্রশ্নের উত্তরে স্বজাতির নিন্দা করতে হয়৷ চাকরিজীবী বাঙালিদের সংখ্যা অসমে বেশি৷ তাঁরা চুপচাপ আছেন৷ সরকারবিরোধী কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন৷ নো ম্যানস ল্যান্ডে তাঁদের এই অবস্থানও নিরাপদ নয়৷ হিন্দুস্থানে হিন্দুদের কোনও ক্ষতি হবে না৷ এমনটাই ধারণা তাদের৷ আর বাঙালি মুসলমানেরা কী ভাবছেন, সেটা বলতে পারব না৷ বাংলাভাষায় কথা বললেই এখানে বাংলাদেশি হয়ে যাচ্ছেন৷ বাঙালিদের এখনো ঘুম ভাঙেনি৷ আমাদের এক রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন, প্রতিদিন ৬ হাজার করে বাংলাদেশি অসমে ঢুকছে৷ তাহলে তো এতদিনে বাংলাদেশে আর একটি লোকও থাকতো না! এটা সাম্প্রদায়িক দুর্গন্ধ ছড়ানোর কাজ৷ এতে ভারতের জাতীয় সংহতি বিপন্ন হচ্ছে৷ 

মুক্তির উপায়?

গণতন্ত্রের স্বার্থে সব বাঙালিকে এই লড়াই লড়তে হবে৷ ভারতীয় সংবিধানের পবিত্রতা বজায় রেখে এই লড়াই ভারতের জন্যই লড়তে হবে৷ বাঙালি জাতিরই ক্ষুদিরাম থেকে মাতঙ্গিনী এই ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়তে প্রাণ দিয়েছিলেন৷ কাজেই কে কোন ভাষায় কথা বলেন, তার ভিত্তিতে আজ বিভাজন করা চলবে না৷  

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷