সখী নর্মাল কারে কয়?
২ অক্টোবর ২০২০দিল্লির এক উত্তর ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে সম্প্রতি ভয়াবহ ঝগড়া হয়েছে। অধমের দিকে আঙুল তুলে প্রতি তিনটি বাক্যে একবার করে কলকাতার বাঙালিকে হুজুগপ্রিয় বলার আনন্দে মেতেছিল সে। যতবার বলেছে, ততবার ততোধিক গলা চড়িয়ে আমরা কত নিয়মনিষ্ঠ তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। বস্তুত, খানিক রং চড়িয়েই বলেছি। উত্তর ভারত পূর্ব ভারতের বঙ্গ জাতিকে হুজুগে বলে গালি পাড়বে, আর তা বিনা যুদ্ধে মেনে নিতে হবে, এমন বান্দা এ বাঙালি নয়।
সেই ঘটনার মাত্র এক দিনের ব্যবধানে কলকাতা আসার সুযোগ হলো। অন্য সময় বছরের এই সময়ে কলকাতার চালচিত্রই বদলে যায়। দিকে দিকে শারদোৎসবের রং। আকাশে শরতের মেঘ। দু'-এক পশলা বৃষ্টি হলেই সোনালি রোদ সর্ষের তেলের রঙে ঢেকে ফেলে চার্নকের শহর। নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে তিল ধারনের জায়গা থাকে না। পুজোর বিকিকিনি কার্যত কার্নিভালের চেহারা নেয়। মলগুলোর বাইরে নানা রঙের আলো। নানা কিসিমের অফার।
বিমানবন্দরে প্লেনের চাকা ছুঁতেই মনটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল। এ কোন কলকাতায় নামছি। এই ভরা শরতেও আকাশে বর্ষার মেঘ। মূহ্যমান হেমন্তের মতো দিকভ্রষ্ট রানওয়ে। আকাশ থেকে দেখা শহরটায় সব আছে, কেবল প্রাণ নেই যেন।
সেই উত্তর ভারতীয় বন্ধুকে মনে মনেই আরো কিছু গাল পাড়লাম। কোথায় হুজুগ, কোথায় কী, আকাশ থেকে এ যে বড় মন খারাপের কলকাতা! বিমানবন্দর থেকে বাড়ির পথে ভুল ভাঙতে শুরু করল। যত এগোলাম, ততই বুঝলাম, কলকাতা আছে কলকাতাতেই। দুই মাস আগেও করোনা ঘিরে মানুষের মনে সামান্য যতটুকু ভয় দেখেছিলাম, এখন তার লেশমাত্র নেই। বাজারহাট দিব্য চলছে আগের মতোই। বাসে বাদুরঝোলা ভিড়। দল বেঁধে ফুচকা, রোলের দোকান মৌমাছির চাক।
নিউ নর্মাল? সে আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? কলকাতার মানুষ এসব শব্দের সঙ্গে পরিচিত নন মোটেই। তাঁরা হুজুগে। সর্ব অর্থে হুজুগে। এতটাই যে সরকার বাহাদুরও করোনা ভুলে দিকে দিকে প্যান্ডেল বাঁধার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। দিল্লিতে সরকার এখনো সে অনুমতি দেয়নি। নিয়ম রক্ষার্থে ঘট পুজোর দিকে ঝুঁকছে অধিকাংশ বড় পুজো। কলকাতায় সব হবে। আবার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢেকে যাবে শহর। রাস্তায় রাস্তায় লাইন। সারা রাত গোল হয়ে বসে গুলতানি অথবা প্যান্ডেল হপিং। সবই হবে। এই করোনাকালেও।
এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আইপিএল। করোনাকালে দর্শকশূন্য গ্যালারির আইপিএল-কেও বলা হচ্ছে নিউ নর্মাল। সেই নিউ নর্মাল আইপিএলের সঙ্গে নর্মাল পুজোর বাজারের একটা সংঘাত অবশ্য শুরু হয়েছে। এক সময় ‘কওন বানেগা ক্রোড়পতি’ গেম শো চলার সময় রাস্তাঘাটে অঘোষিত কারফিউ লেগে যেতো। সকলেই বসে পড়তেন টেলিভিশন সেটের সামনে। অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোন ভয়েস আর আমার আপনার মতোই মধ্যবিত্ত আমআদমির হঠাৎ কোটিপতি হয়ে যাওয়ার অতিবাস্তব মোহিত করে রেখেছিল সাধারণ মানুষকে।
আইপিএল-ও মোহিত করে রাখে। চিয়ার লিডার, ডাগ আউট, শাহরুখ-প্রীতি জিন্টা, আর মারকাটারি শট ক্রিকেটকে আরো বেশি উত্তেজক করে তুলেছে। গেল বছরেও ইডেনে ম্যাচ থাকলে কলকাতার সব রাস্তা ধর্মতলায় গিয়ে মিশতো। অনেকেরই প্রশ্ন ছিল, এই করোনাকালে সুদূর মরু অঞ্চলে দর্শকবিহীন আইপিএল কলকাতার বাঙালিকে আকর্ষণ করতে পারবে তো? মাঠের স্বাদ টেলিভিশনে মিটবে কি?
পুজোর বাজারের সঙ্গে আইপিএলের অঘোষিত যুদ্ধ বিলক্ষণ লেগে গিয়েছে। বাজার বিনোদন আর ক্রিকেট বিনোদনেরমধ্যে রীতিমতো রেষারেষি চলছে। হিন্দিতে একটা কথা আছে, আঁখো দেখা হাল, অর্থাৎ, চোখে দেখা পরিস্থিতি। এখনো পর্যন্ত সেই চোখে দেখা অভিজ্ঞতা বলছে, আইপিএলকে সামান্য পিছনে রেখে এগিয়ে আছে পুজোর বাজার। বস্তুত, কোনো কোনো মলে বড় স্ক্রিনে আইপিএল চালিয়ে দিয়ে এক ঢিলে সব পাখি মারার চক্রান্ত হয়েছে। বাড়িতে বন্দি না থেকে মলে ঢুকে এক সঙ্গে খেলা দেখার কর্মকাণ্ড বাঙালি শুরু করে দিয়েছে। বাড়ির কাছেই একটি মলের কর্তৃপক্ষ জানালেন, মলে আইপিএল চালিয়ে পুজোর বাজার আরো জমিয়ে তোলা গিয়েছে। মানুষ খেলাও দেখছেন, জিনিসও কিনছেন।
নিউ নর্মাল সংস্কৃতি নিয়ে গোটা পৃথিবীতেই এখন আলোচনা হচ্ছে। বাড়িতে বসেই রক কনসার্ট শোনা যাচ্ছে। ফাঁকা গ্যালারিতে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, রাগবি, বেসবল হচ্ছে। মানুষ ঘরে বসে তা উপভোগ করছেন। করোনাকালে সংস্কৃতির মূল ধারাটাই বদলে যেতে শুরু করেছে। মানুষকে ঘরে বসিয়ে রেখেও কীভাবে অটুট বিনোদন উপহার দেওয়া যায়, তার বিবিধ পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু কলকাতা আছে কলকাতাতেই। এখানে করোনাকালে মলে ভিড় জমানোই নিউ নর্মাল। এখানে করোনাকালে পুজোর কার্নিভালই নিউ নর্মাল। এখানে ফাঁকা স্টেডিয়ামের আইপিএল মলে ভিড় করে দেখাই নিউ নর্মাল। এখানে হুজুগই আসলে বরাবরের নর্মাল। করোনা-টরোনা আবার কী?