মরুর দেশে ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া আইপিএল
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০তার মানে এই না যে, করোনা বিনা যুদ্ধে হার মেনেছে৷ ঠিকই তা ছাপ রেখে যাচ্ছে ভারতের ঘরোয়া একটা টুর্নামেন্টের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক রূপ নিয়ে নেওয়া এই রংবাহারি আয়োজনে৷ আদৌ হবে কি হবে না দোলাচলে ভুগে শেষ পর্যন্ত যা শুরু হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ছয় মাস পর৷ করোনা ভাইরাস টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে লম্বা সময়ের জন্য আইসোলেশনে পাঠিয়ে না দিলে এ বছর যেটি আর হতোই না৷
এর চেয়েও বড় পরিবর্তন, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ইন্ডিয়াতে নয়, আয়োজিত হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে৷ কারণটা বলতে গেলে পুনরুক্তি হবে৷ করোনার থাবায় ক্ষতবিক্ষত ভারতে আইপিএল আয়োজনের মতো অবস্থা নয়, তুলনায় ‘নিরাপদ’ মরুর দেশকেই তাই ঠিকানা করে নিতে হয়েছে৷ আর কোনো বিকল্পই আসলে ছিল না৷ কাছাকাছি দূরত্বের এমন তিনটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম আর কোথায় পাওয়া যেতো? কলম্বোর কথা বলছেন? বাংলাদেশ দলের সফর নিয়েই যা হচ্ছে, তা জানা থাকলে এ নিয়ে আর কথা বাড়ানোর কথা নয়৷
এতে অবশ্য নতুন কিছু হচ্ছে না৷ ভারতের বাইরে এর আগেও তো হয়েছে আইপিএল৷ সেটিও দ্বিতীয় বছরেই৷ ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় স্থানান্তরিত হওয়ার কারণ ছিল ভারতের জাতীয় নির্বাচন৷ সেবার প্রশ্ন উঠেছিল, স্বাগতিক উন্মাদনাকে মূল পুঁজি করা হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে খেলার ফরম্যাট ভেঙে গেলে আইপিএল আদৌ জমবে কিনা৷ এবার এমন কোনো প্রশ্ন করারই অবকাশ নেই৷ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাস এতদিনের চেনা পৃথিবীটাকে এমনই বদলে দিয়েছে যে, সব কিছুরই এখন অন্য নিয়ম৷ দর্শকশূন্য মাঠে খেলাটাই যেমন এখন পরিণত ‘নিউ নরম্যালে'৷ গত মৌসুমের ইউরোপের ফুটবল লিগগুলো এভাবেই শেষ করে নতুন মৌসুমও শুরু হয়ে গেছে অস্বাভাবিক এই নতুন স্বাভাবিকতাকে মেনে নিয়েই৷ একই শহরে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অধ্যায়টা আয়োজনের অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খা খা করছে গ্যালারি, শূন্য গ্যালারি সামনে রেখেই হয়ে গেছে একটা গ্র্যান্ড স্লাম টুর্নামেন্ট৷ গ্যালারিতে দর্শক যেন হয়ে যেতে বসেছে গত জনমের স্মৃতি৷ যে আইপিএলের মূল প্রাণ উৎসবমুখর গ্যালারি, সেটিরও মূল থিম এবার শূন্য গ্যালারি এবং টেলিভিশনের জন্য খেলা৷
তা বাণিজ্যিকীরণের এই যুগে খেলাতে তো অনেক দিনই এই টেলিভিশন-রাজ৷ গেট মানিকে তুচ্ছ বানিয়ে টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ত্বেই আসল মণিকাঞ্চনযোগ৷ এই করোনাকাল তা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই যা! আইপিএলের ক্ষেত্রে যা আরো বেশি প্রতীকী তাৎপর্য পেয়ে যাচ্ছে৷ বাণিজ্যকে মাথায় রেখেই (কথাটা এখানে দ্ব্যর্থক) তো জন্ম এই টুর্নামেন্টের, যেটি বদলে দিয়েছে ক্রিকেট মানচিত্রকেই৷
একটা সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বিভাজনরেখা ধরে নিয়ে ক্রিকেটকে যুদ্ধ-পূর্ব আর যুদ্ধ-উত্তর যুগে ভাগ করা হতো৷ গত শতকের সাতের দশকে কেরি প্যাকার সিরিজ টেনে দিয়েছিল আরেকটি পরিষ্কার বিভাজনরেখা৷ ভাবীকালের ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা নিশ্চিতভাবেই ক্রিকেটকে ভাগ করবেন আইপিএল-পূর্ব ও আইপিএল পরবর্তী দুটি ভিন্ন সময়ে৷ ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডে বৈকালিক বিনোদন হিসাবে যে টি-টোয়েন্টির জন্ম, সেটিকে এমন অর্থপ্রসবা করে তুলে ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার কৃতিত্ব বা দায় তো এই আইপিএলেরই৷ এর ব্র্যান্ড ভ্যালুর হিসাব হয় বিলিয়ন ডলারে, মিলিয়ন ডলারে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের অংক৷ নামী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের স্বপ্নেও রং ছড়ায় একটা আইপিএল কন্ট্রাক্ট৷ নিলামের ওই একটা দিনই বদলে দিতে পারে যার পৃথিবী৷ মাস দেড়েকের একটা টুর্নামেন্ট খেলেই নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারেন বাকি জীবনের জন্য৷ শুধুই কি বর্তমান ক্রিকেটার; সাবেকদের জন্য কোচের চাকরি আছে, শুধু নামটা ব্যবহার করতে দিয়ে ‘মেন্টর’ পদ….ফিজিও, ট্রেনার, আম্পায়ার, ধারাভাষ্যকার আরো কত ভূমিকায় টাকা কামানোর সুযোগ৷ সব মিলিয়ে আইপিএল যেন ক্রিকেটের দুনিয়ায় প্যারালাল একটা ইন্ডাস্ট্রি৷ যেটির দেখানো পথ ধরে প্রায় প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আসর৷ কিন্তু আর কোনোটিই আইপিএলের মতো এমন ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ কথাটার সমার্থক হয়ে উঠতে পারেনি৷ এটির এমনই প্রভাব যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচি ঠিক করার সময়ও আইপিএলের কথাটা মনে রাখতে হয় বাকি সব দেশকে৷ নইলে যে ক্রিকেটাররা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন! অনেক ক্রিকেটারের কাছেই তো দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার চেয়ে বড় আইপিএলের হাতছানি৷ টেস্ট-ওয়ানডে বাদ দিয়ে শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলেই তো জীবন পার করে দিচ্ছেন অনেকে৷ ‘ফ্রি ল্যান্স ক্রিকেটার’ কথাটাও এখন আর অপরিচিত কিছু নয়৷
এই যে আইপিএল নিয়ে এত কথা বলে ফেললাম, অথচ ক্রিকেটটা সেভাবে এলোই না, প্রতীকী ধরতে পারেন এটাকে৷ টুর্নামেন্টের নামের সঙ্গেও যে ‘ক্রিকেট' কথাটা নেই, এটাও কি প্রতীকী নয়! ক্রিকেট খেলাটাকে ঘিরেই এই আয়োজন, এখানেও ছয় বলেই ওভার, চার-ছয়ের একই নিয়ম, তবে বাকি সব অনুষঙ্গের ঢক্কা-নিনাদে অনেক সময়ই যেন চাপা পড়ে যায় ক্রিকেট৷ খেলা আর শো বিজ মিলিয়ে এটা যে অন্যরকম এক ককটেল!
ভারতের সংবাদ মাধ্যমে একটা কথা খুব প্রচলিত৷ ভারতীয় ভোক্তাদের আগ্রহ ঘুরপাক খায় তিনটি ‘সি’তে---ক্রিকেট, সিনেমা আর ক্রাইম৷ শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতা, জুহি চাওলাদের টেনে এনে শুরু থেকেই আইপিএল প্রথম দুটি ‘সি'র ককটেল৷ তৃতীয় ‘সি'টার উপস্থিতিটা মাঝে মধ্যে সরব হয় ফিক্সিং কেলেঙ্কারির রূপ ধরে৷ আর নীরবে তো সেটি বয়েই চলে অবৈধ জুয়ার বাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার হাত বদলের মাধ্যমে৷
টুর্নামেন্টের নামের সঙ্গে ‘ক্রিকেট’ না থাকার অবশ্য ঐতিহাসিক একটা কারণ আছে৷ আইপিএলের জন্মের ইতিহাসটা যদি মনে করতে পারেন, তাহলে আপনার অবশ্যই মনে পড়বে এমন আরেকটি টুর্নামেন্টের কথা৷ তার নামের সঙ্গে ক্রিকেট ছিল৷ আইসিএল, অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ৷ ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার সূচনাও এই আইসিএলের হাত ধরেই৷ কাকতালীয়ভাবে প্যাকার সিরিজের মতো এর জন্মও টিভি সম্প্রচার স্বত্ত্ব নিয়ে বিরোধ থেকে৷ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ত্ব না পেয়ে চ্যানেল নাইনের ধনকুবের মালিক কেরি প্যাকার বিশ্বের সেরা সব ক্রিকেটারকে গোপনে দলে টেনে শুরু করে দিয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ৷ সেই প্রথম ফ্লাডলাইটের আলোয় ক্রিকেট, রঙিন পোশাক, সাদা বল৷
অস্ট্রেলিয়ায় কেরি প্যাকার যা করেছিলেন, প্রায় তিন দশক পর ভারতে তা-ই করার চেষ্টা করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র৷ ভদ্রলোক ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল জি টিভির মালিক৷ জি স্পোর্টস নামে একটি স্পোর্টস চ্যানেল চালুই করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ত্ব পেতে৷ তা পেয়ে গেলে আর আইসিএলের জন্ম হয় না৷ আর ২০০৭ সালে আইসিএল শুরু না হলে পরের বছরই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আইপিএল নিয়ে মাঠে নেমে যায় না৷ ইতিহাসের বাঁক বদলের এই সময়গুলো খুব কৌতুহলোদ্দীপক, যা প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে মনে, এটা না হলে তো ওটা কি হতো? আইসিএল না হলে আইপিএল?
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তীব্র বিরোধিতা আর বাকি ক্রিকেট বিশ্বেরও তার সঙ্গে তাল মেলানোয় দুই মৌসুম পরই বন্ধ হয়ে যায় আইসিএল৷ কেরি প্যাকার যেখানে ক্রিকেটকে নতুন যুগে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব পান, প্রায় একইরকম কাজ করার পরও সুভাষ চন্দ্রের নাম সেভাবে উচ্চারিতই হয় না৷
আইপিএলের এই রমরমা দেখে সুভাষ চন্দ্রের বুক চিরে কি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয়?