সংসদে নেই, তবুও আলোচনায় এফডিপি
১৮ জুন ২০১৭জার্মানির সংসদের নিম্ন কক্ষ বুন্ডেসটাগে কোনো আসন না থাকলেও আলোচনা থেমে নেই ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এফডিপি) বা মুক্ত গণতন্ত্রী দল নিয়ে৷
সম্প্রতি দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যের মোড়ঘোরানো নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে চলে এসে চমক দেখিয়েছে তারা৷ এবার দৃষ্টি দিয়েছে রাজধানী বার্লিনের দিকে৷
ছোট দল আর সীমিত জনসমর্থন নিয়েও একটি দল কীভাবে ক্ষমতার চাবি নিজেদের মতো করে ঘোরাতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এফডিপি৷
আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের রক্ষণশীল দল নিজেদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ চালাবে – এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷ তাই তারা যদি সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডির সাথে আরেকটি মহাজোট সরকার না করতে চায়, তাহলে হয়তো দৃষ্টি দিতে হবে ব্যবসা-বান্ধব মধ্যপন্থি এফডিপির দিকে৷
অতীতে উদার হিসাবে পরিচিত এই দলটির চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ার থেকে হেলমুট কোল হয়ে ম্যার্কেল পর্যন্ত রক্ষণশীল নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে৷
মধ্যপন্থি হওয়ার কারণে সামাজিক গণতন্ত্রীদের সঙ্গেও যায় মুক্ত গণতন্ত্রীরা৷ এফডিপি সামাজিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচিত চ্যান্সেলর ভিলি ব্রান্ট এবং হেলমুট স্মিট-এর সময়ে জোট সরকারের অংশীদার ছিল৷ পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী বামদলের সঙ্গে এসডিপির জোট গঠনের বিরুদ্ধে বেশ বড় বিক্ষোভ হয়েছিলো৷ সুতরাং মার্টিন শুলৎসের নেতৃত্বাধীন এসপিডিরও জোট করার জন্য মুক্ত গণতন্ত্রী বা সবুজ দল ছাড়া অন্য উপায় নেই৷
বর্তমানে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তরুণ চেয়ারম্যান ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার৷ এমনও হতে পারে, তাঁর পছন্দই আঙ্গেলা ম্যার্কেল বা মার্টিন শুলৎসের একজনকে চ্যান্সেলর বানিয়ে দিতে পারে৷
এফডিপি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?
দলটি টানা ৬৪ বছর সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে৷ তবে ২০১৩ সালে ৫ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় তারা সংসদের প্রতিনিধিত্ব হারায়৷ এর কারণ হিসাবে অনেকাংশে নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়৷ ব্যাপকভাবে এমন ধারণাও রয়েছে যে, দলটি কেবল ক্ষমতায় থাকতে চায়, আইন প্রণয়নে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই৷ ৩৮ বছর বয়স্ক লিন্ডনার এ সব বিষয় থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন৷ সম্ভাব্য জোট সহযোগী নির্ধারণ না করে তিনি রাজনৈতিক অবস্থানের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন৷
এফডিপি কী করতে চায়?
তাদের দুইটা প্রধান নীতি হলো, বেসরকারি খাতে কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ বা প্রণোদনা থাকবে না৷ বাজার হবে একেবারে উন্মুক্ত৷ ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে৷
গত ৩০ এপ্রিল পার্টি কনফারেন্সে প্ল্যাটফর্ম অনুমোদন হয়েছে৷ সেখানে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়, ডিজিটাইজেশন এবং শিক্ষা৷ তারা দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং ডিজিটাল অ্যাফেয়ার্স নামে একটা মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করার অঙ্গীকার করছে৷ স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়৷
মুক্ত গণতন্ত্রীরা দ্বৈত নাগরিকত্বকে সমর্থন করে৷ সিডিইউ-সিএসইউ সেটা করে না৷ এফডিপি তৃতীয় প্রজন্মে এসে অভিবাসীদের এক নাগরিকত্ব রাখার পক্ষে৷ উদ্বাস্তু সংকট মোকাবিলায় ম্যার্কেল সরকারের পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেছেন লিন্ডনার৷ তিনি বলেছেন, ‘এই মানুষদের যথাযথ স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়া হয়নি'৷ আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হওয়ার সংশ্লিষ্টদের দ্রুত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানান৷
স্বচ্ছলদের দল এফডিপি কর ছাড়েও খুশি হয়৷
এফডিপির ইতিহাস ভাগ্য বদলের ইতিহাস৷ দশকের পর দশক তারা সরকারে অংশ নিয়েছে৷ ‘কিংমেকার' হিসাবে তারা তাদের প্রভাব দেখাতে চায়৷ ১৯৮২ সালে দলটির মন্ত্রী সামাজিক গণতন্ত্রীদের চ্যান্সেলর স্মিটকে ত্যাগ করে৷ রক্ষণশীলদের কোল-এর উত্থানে ভূমিকা রাখেন৷ হেলমুট কোল-এর সঙ্গে এফডিপি থেকে হওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হান্স-ডিট্রিশ গেনশারকে দুই জার্মানির একত্রীকরণের অনুঘটক মনে করা হয়৷
১৯৯৮ সালে এসপিডির গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার সবুজ দলের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় গেলে ২৯ বছর পর সরকারের বাইরে চলে যায় এফডিপি৷ এ সময় দলটি পরের নির্বাচনে ১৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার লক্ষ্যও নির্ধারণ করে৷
২০০৯ সালের নির্বাচনে দলটি ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পায় এবং ম্যার্কেলের সরকারে যোগ দেয়৷ তবে এ সময় সবকিছু ভালোভাবে কাটেনি৷
দলটি নেতা গিডো ভেস্টারভেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন৷ তবে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময় ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বিবিসির এক সাংবাদিককে জার্মান ভাষায় কথা বলতে বলে তিনি সমালোচিত হন৷ একের পর এক স্থানীয় নির্বাচনে হারতে থাকে তারা৷ ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে এসে দলটি পায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট৷ যাতে দলটি সংসদে প্রতিনিধিত্ব হারায়৷ এরপরই লিন্ডনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷
এফডিপির সামনের সুযোগ
মুক্ত গণতন্ত্রীদের অনেক সদস্য রয়েছে৷ কিন্তু মানুষের জন্য তাদের বার্তা কী? বর্তমান নেতা লিন্ডনার গণমাধ্যম বান্ধব এবং তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে৷ কিন্তু জনগণকে একতাবদ্ধ করার মতো ইস্যুর খরায় রয়েছে দলটি৷
অবশ্য সম্প্রতি জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার নির্বাচনে এফডিপি সফলতা পেয়েছে৷
রক্ষণশীলদের সাথে এফডিপির দ্বি-দলীয় জোট সম্ভব৷ সেটা হলে চার বছর পর ক্ষমতায় ফিরবে দলটি৷ সবুজ দলের সঙ্গে মিলে রক্ষণশীল বা সামাজিক গণতন্ত্রী যে কারো সঙ্গে তারা ক্ষমতায় ফিরতে পারে৷ অবশ্য সবুজ দলের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত প্রতিযোগিতা সেই সম্ভবনাকে কমিয়ে দেয়৷ একটা সময় তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি ছিল এফডিপি৷ সবুজ দল এই স্থানটি কেড়ে নিয়েছে৷ এটা তারা কোনোদিনই ভুলতে পারেনি৷
সবকিছুর মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে মুক্ত গণতন্ত্রী দল এফডিপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে৷