জার্মানিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া
১৩ জুন ২০১৭জার্মান সংবিধানের ৩৮তম সূত্রের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সার্বজনীন, মুক্ত, সমতাপূর্ণ ও গোপন নির্বাচনের' মাধ্যমে ‘বুন্ডেসটাগের' সদস্যদের নির্বাচন করা হবে৷ এর অর্থ, সব প্রাপ্তবয়স্ক (যাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর) তাঁদের সম্পত্তি, শিক্ষার মান অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে ভোট দিতে পারবেন৷ প্রত্যেক ভোটারের দু'টি করে ভোট থাকবে: প্রথমটি কোনো প্রার্থীর জন্য; দ্বিতীয়টি কোনো দলের সমর্থনে৷ এছাড়া ভোটদান পর্ব গোপনে সম্পন্ন হবে৷
একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন অথবা সুইজারল্যান্ডের থেকে জার্মান নির্বাচন পদ্ধতির মূল পার্থক্য হলো এই যে, জার্মানিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ নয়, বরং প্রতিনিধিত্বমূলক৷ এক্ষেত্রে সাংসদদের একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রয়েছে৷ তাঁরা জনগণের মনোভাব ও ইচ্ছার প্রতিনিধি৷ সুইজারল্যান্ডকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়৷ সুইসরা গণভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে থাকেন৷ জার্মানিতে কিন্তু শুধুমাত্র গণপ্রতিনিধি, অর্থাৎ সাংসদদের মাধ্যমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় – আইন পাস করা হয়৷ সেই হিসেবে প্রত্যেক গণপ্রতিনিধির উপর একটি গুরুভার ন্যস্ত রয়েছে৷
জার্মান সংবিধানের বয়ানে সাংসদরা ‘সমগ্র জনগণের প্রতিনিধি এবং কোনো আদেশ বা নির্দেশে আবদ্ধ নন ও শুধু তাদের নিজেদের বিবেকের কাছে দায়ী৷' সংবিধানের দৃষ্টিতে সাধারণ ভোটারদেরও নির্বাচন পদ্ধতির উপর নজর রাখার, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্পিত৷ যদি কোনো ভোটারের মনে হয় যে, ভোটপর্বে কোনোরকম ব্যাঘাত বা ব্যতিক্রম হয়েছে, তাহলে তিনি ভোট বাতিল করার দাবি তুলতে পারেন৷
‘বুন্ডেসটাগ'
জার্মান সংসদের নাম ‘বুন্ডেসটাগ' – আক্ষরিক অর্থে, ফেডারাল সম্মেলন৷ ২০০২ সাল থেকে বুন্ডেসটাগের সদস্যসংখ্যা হলো ৫৯৮৷ এর মধ্যে ২৯৯টি আসন অধিকার করেন সেই সব প্রার্থী, যাঁরা সংশ্লিষ্ট ২৯৯টি নির্বাচনি এলাকায় সর্বাধিক ভোট লাভ করেছেন৷ এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপর কোনো শর্ত নেই৷ এমন প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচিত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়৷ সংসদের বাকি ২৯৯টি আসনের দাবিদাররা আসেন ভোটারদের দ্বিতীয় বা দলীয় ভোট থেকে৷ রাজনৈতিক দলগুলির তথাকথিত ‘প্রাদেশিক প্রার্থী তালিকা' অনুযায়ী, এই সাংসদরা বুন্ডেসটাগে আসন গ্রহণ করেন৷ ১৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিটি দল রাজ্য বা প্রদেশ অনুযায়ী তাদের প্রার্থী তালিকা পেশ করে; প্রদেশিক তালিকাগুলি মিলিয়ে প্রত্যেক দলের একটি ‘ফেডারাল প্রার্থী তালিকা' সৃষ্টি হয়; এই তালিকার শীর্ষের থাকেন দলের শীর্ষ প্রার্থী৷ এ-বছরও আঙ্গেলা ম্যার্কেল সিডিইউ দলের শীর্ষ প্রার্থী, যেমন মার্টিন শুলৎস এসপিডি দলের তালিকার শীর্ষে৷ মনে রাখা দরকার, জনগণ নয়, সাংসদরাই তাদের সমর্থনের মাধ্যমে ফেডারাল চ্যান্সেলর নির্বাচন করে থাকেন৷
প্রথম ও দ্বিতীয় ভোট
প্রত্যেক ভোটারের যে দু'টি ভোট থাকে, এক হিসেবে তার মধ্যে দ্বিতীয় ভোটটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এই দ্বিতীয় ভোট থেকেই বুন্ডেসটাগে কোন দলের কয়টি আসন থাকবে, তা নির্ধারিত হয়৷ উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি দ্বিতীয় ভোটের ৩৫ শতাংশ পেয়ে থাকে, তবে সংসদে সেই দলের ৩৫ শতাংশ আসন থাকবে৷ দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে ভোটাররা সংসদে রাজনৈতিক দলগুলির দলগত শক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইত্যাদি নির্ধারণ করে থাকেন৷ দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে একটি দল কতগুলি আসন জয় করেছে, তা নির্দিষ্ট হওয়ার পর সেই বাড়তি আসনগুলি প্রাদেশিক প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী বণ্টন করা হয়৷ প্রসঙ্গত, ভোটাররা এক দলের প্রার্থীকে তাদের প্রথম ভোট ও আরেক দলকে তাদের দ্বিতীয় ভোট দিতে পারেন৷ শুধুমাত্র প্রথম বা দ্বিতীয় ভোট প্রদান করাও সম্ভব৷
মুশকিল হয়, যদি কোনো দল দ্বিতীয় ভোট অনুযায়ী তাদের যত আসন পাওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি আসন প্রথম বা সরাসরি ভোটেই জয় করে থাকে৷ এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে এবং এর ফলে সংসদের আসনসংখ্যা বেড়ে যায়: দলটি প্রথম ভোটের মাধ্যমে যেসব আসন জয় করেছে, সেগুলি থেকে যায়, দ্বিতীয় ভোটের অনুপাত অনুযায়ী কমে যায় না৷ এর ফলে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায়, কেননা, দ্বিতীয় ভোট অনুযায়ী অন্যান্য দলের প্রাপ্য আসনের অনুপাত বজায় রাখার জন্য তাদের বাড়তি আসন প্রদান করতে হয়৷
২০১২ সালে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে বাড়তি আসনের ব্যাপারে এই আপোশ করা হয়৷ এর অসুবিধা হলো এই যে, এর ফলে বুন্ডেসটাগের কলেবর খুব বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে৷ এ কারণেই সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর বুন্ডেসটাগের সদস্যসংখ্যা বেড়ে ৭০০ হবার সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে৷ কাজেই বাড়তি আসনের সংখ্যা সীমিত করা নিয়ে আলোচনা চলেছে৷
ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ ভোটের বেড়া
এই প্রতিবন্ধক জার্মান নির্বাচন পদ্ধতির একটি বিশেষত্ব বলা চলে৷ তবেঅন্যান্য দেশেও এর চল রয়েছে৷ যেমন, ইসরায়েলে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ অথবা তুরস্কে ১০ শতাংশ ন্যূনতম ভোটের বেড়া, নয়তো একটি রাজনৈতিক দল সংসদে আসন নিতে পারে না৷ জার্মানিতে এই পাঁচ শতাংশ ন্যূনতম ভোটের শর্ত রাখার কারণ হলো, গত শতাব্দীর বিশের দশকে সংসদে বহু দলের উপস্থিতির ফলে স্থিতিশীল সরকার গঠন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কিন্তু সমালোচকরা যুক্তি দেখান যে, পাঁচ শতাংশে না পৌঁছনোর কারণে বহু প্রদত্ত ভোটের অপচয় হয়: ২০১৩ সালের নির্বাচনে এই পন্থায় প্রায় ৭০ লাখ ভোট অপচয় হয়েছিল৷ ন্যূনতম ভোটের বেড়া নিয়ে যাবতীয় তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটের বেড়া বহালই থাকছে৷
ভাগনার ফলকার / এসি