লিবিয়ার বিদ্রোহীদের মধ্যে ফাটলের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে
৫ আগস্ট ২০১১বিদ্রোহীদের শিবিরে সমস্যা
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ ন্যাটোর সহায়তায় প্রায় ৫ মাস ধরে গাদ্দাফির বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালানোর পরেও বিদ্রোহীরা প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারে নি৷ ফলে দেশে চরম অরাজকতা বা উগ্র ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ আব্দুল ফাতাহ ইউনিসের হত্যাকাণ্ড সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ বিদ্রোহী শিবিরের মধ্যেই ক্ষমতা দখলের গোপন লড়াই চলছে কি না, সেই প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে৷ বিদ্রোহী বাহিনীর সামরিক কাঠামোর একটা বড় ভরসা ছিলেন ইউনিস৷ এককালে গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠ এই সামরিক কর্মকর্তা যখন বিদ্রোহের শুরুতেই বিরোধীদের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বিশাল অভিজ্ঞতা নতুন এক উদ্দীপনা এনে দিয়েছিল৷
বিতর্কিত চরিত্র ইউনিস
তবে ইউনিসকে ঘিরে বিতর্কও কম ছিল না৷ ১৯৬৯ সালে যে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গাদ্দাফি ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তার অন্যতম স্থপতি ছিলেন ইউনিস৷ ফলে এবারও তিনি বিদ্রোহী শিবিরে থেকে গোপনে আসলে গাদ্দাফির হয়ে কাজ করছেন কি না, সেবিষয়ে কিছু মহলে গভীর সন্দেহ দেখা দিয়েছিল৷ বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতা আশউর আল শামেস অবশ্য মনে করেন, গাদ্দাফির লোকেরাই ইউনিসকে হত্যা করেছে৷ তিনি আরও বললেন, ‘‘গাদ্দাফিই একমাত্র ব্যক্তি, আব্দুল ফাতাহ ইউনিসের মৃত্যুর ফলে যার উপকার হয়েছে৷ কারণ ইউনিসই বছরের পর বছর ধরে তাঁর পাশে ছিলেন এবং গাদ্দাফি সম্পর্কে অন্য কেউ এতো কিছু জানতো না৷ ইউনিস যে কোনো দিন সেসব তথ্য ফাঁস করে দিতে পারতেন৷ তিনি লিবিয়ার সেনাবাহিনী ও ভাড়াটে বাহিনীর চরিত্র সম্পর্কে বেশ ভালোই খবর রাখতেন৷ গাদ্দাফির ক্ষমতাকেন্দ্র সম্পর্কেও তাঁর সবচেয়ে ভালো ধারণা ছিল৷ এসব কারণে তাঁকে বিপজ্জনক মনে করা হতো৷''
ইউনিস সম্পর্কে সংশয়
এই অনুমান কতটা সত্য, তা বলা কঠিন৷ ইউনিসের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অস্পষ্টতা এখনো কাটে নি, হত্যাকারী সন্দেহে শুধু কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুরু থেকেই বিদ্রোহী শিবিরের একাংশ ইউনিসকে মেনে নিতে পারে নি৷ লিবিয়া বিশেষজ্ঞ আলফ্রেড হাকেন্সব্যার্গার মনে করেন, বিদ্রোহীদের একাংশই ইউনিসের হত্যার জন্য দায়ী৷ তিনি বললেন, ‘‘একথা সবাই জানে যে বাস্তবে বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই৷ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে এই আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে৷ এই বাস্তব সত্য হয় অস্বীকার করা হয়েছে, অথবা সংবাদ মাধ্যম বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয় নি৷ বিদ্রোহীদের মধ্যে এমনকি বেশ কিছু উগ্র ইসলামপন্থী ও কোনো নেতার ব্যক্তিগত মিলিশিয়া বাহিনীও রয়েছে৷ শোনা যায়, গাদ্দাফি-পন্থী মিলিশিয়াও নাকি বিদ্রোহীদের মধ্যে মিশে গেছে৷''
বিদ্রোহী শিবিরের চালচিত্র
হাকেন্সব্যার্গার আরও জানালেন, যে দেশের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের বিদ্রোহীদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত কারণে গভীর মতভেদ রয়েছে৷ শুধু গাদ্দাফির বিরোধিতাই তাদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে৷ পূবের জনগোষ্ঠী পশ্চিমের তুলনায় অনেক বেশি রক্ষণশীল৷ সেখানে রাস্তাঘাটে বেশি নারী দেখা যায় না৷ উগ্র ইসলামপন্থীদের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে যে আশঙ্কা রয়েছে, সেবিষয়ে বিদ্রোহী নেতা আশউর আল শামেস মনে করেন, বেনগাজিতে কিছু সশস্ত্র কট্টরপন্থী মিলিশিয়া আছে৷ বিদ্রোহের প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও ক্রমশ তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে৷ এখন তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে৷
উগ্র ইসলামপন্থীদের দৌরাত্ম্য
তবে বাস্তব সত্য হল, বিদ্রোহীদের মধ্যে আফগানিস্তান ও ইরাক-ফেরত যোদ্ধারা মিশে রয়েছে৷ যোদ্ধা হিসেবে তারা বাকিদের থেকে বেশি দক্ষ৷ তারা একসময় আল কায়েদার হয়েও সংগ্রামে অংশ নিয়েছে বলে শোনা যায়৷ দার্না শহরের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদেরই একজন৷ তিনি নাকি খোদ ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন৷ এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত উগ্র ইসলামপন্থীরাই ইউনিসের হত্যার জন্য দায়ী প্রমাণিত হলে বিদ্রোহীদের ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাবে৷ ইতিমধ্যে প্রায় ৩০টিরও বেশি দেশ তাদের পরিষদকেই লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ বিদেশে গাদ্দাফির গচ্ছিত অর্থ ও সম্পত্তি বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে৷ সেই অর্থের ভাগ পেতেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে প্রবল রেষারেষি মোটেই তেমন বিস্ময়ের কারণ নয়৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী