যুদ্ধাপরাধের বিচার থামাবে না ঐক্যফ্রন্ট
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮বিশ্লেষকরা ইশতাহারের ৩৫ দফায় আর যেসব প্রতিশ্রুতি আছে, সেগুলোকে গতানুগতিক বললেও এই দু'টি ঘোষণাকে চমক হিসেবে দেখছেন৷ তবে তাঁরা বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ৷ কারণ, ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি আছে৷ আর বিএনপি'র ২০ দলে আছে জামায়াত৷ তারা সবাই আবার বিএনপি'র ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে৷ অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উঠিয়ে দেয়া বাংলাদেদেশের বাস্তবতায় কতটা সম্ভব তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন৷
সকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৩৫ দফা ইশতাহার তুলে ধরেন ফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন এবং নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না৷ বিএনপি'র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি নেতা আ স ম আব্দুর রব, ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডা. জাফরউল্লাহ সহ আরো অনেকেই সেখানে ছিলেন৷
ড. কামাল হোসেন সংক্ষিপ্ত আকারে ইশতাহারের ১৪টি পয়ন্টে তুলে ধরেন৷ মাহমুদুর রহমান মান্না এরপর ৩৫ দফা ইশতাহারের বিস্তারিত তুলে ধরেন৷
১. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ চলমান রাখা
২. নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান করা
৩. প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা
৪. একটানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা
৫. পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা না রাখা
৬. ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল
৭. হত্যা ও গুম পুরোপুরি বন্ধ করা
৮. জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন করা
৯. গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করা
১০. ক্ষমতায় গেলে প্রথম বছরে গ্যাস, কিদ্যুতের দাম না বাড়ানো
১১. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা
১২. ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া৷
১৩. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া
১৪. বর্তমান সরকারের আমলের দুর্নীতি তদন্ত করে তার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা
ইশতাহারে বলা হয়েছে, প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য৷ এই লক্ষ্যে তারা বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান, তথ্য প্রযুক্তি, কৃষি, শিল্পায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, গণমাধ্যম, নারী, প্রবাসী কল্যাণ, শিল্পায়নসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি খাতেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা এবং বিচারকদের অবসরে যাওয়ার মেয়াদ ৭০ বছর করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷ পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবাং মিথ্যা মামলায় সহায়তাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে৷ ড. কামাল হোসেন তাঁর ইশতাহার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন৷
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতাহার ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,‘‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতাহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখা ও দুর্নীতিরোধের অঙ্গীকার জাতির সঙ্গে তামাশা৷''
তিনি বলেন, ‘‘২৩ জনের বেশি যুদ্ধাপরাধীর উত্তরসূরী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছে৷ আর যুদ্ধাপরাধীরা ঐক্যফ্রন্টের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই আছে৷সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা করবে—এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার, অবিশ্বাস্য৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তারেক জিয়া দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত৷ খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন হাওয়া ভবন তৈরি করে দুর্নীতির আখড়া তৈরি করেছিলেন৷ খালেদা জিয়া নিজে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত৷ তাদের মুখে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার কথা ভূতের মুখে রাম নাম৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মমজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইশতাহারে নতুন দু'টি বিষয় আছে৷ আর সব গতানুগতিক৷ যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার যে কথা ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, তাতে প্রমাণ হয় মুক্তিযদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করা যায় না৷ এটাকে অস্বীকার করে এগোনো সহজ নয়৷ তবে বাস্তবে তারা ক্ষমতায় গেলে এটা পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে৷ কারণ, তাদের সঙ্গে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াতও আছে৷ আর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি'র মিত্রতা আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা কথার ফুলঝুড়ি হতে পারে৷ কারণ, এতে তরুণদের চাকরির সুযোগ কমে যেতে পারে৷ তারা এর বিরোধিতা করতে পারেন৷''
তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেয়া শর্তসাপেক্ষে হতে পারে৷ একজন কতবার সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে পারবেন, শারীরিক ফিটনেস, বিশেষ পেশাগত যোগ্যতা প্রভৃতি আরো অনেক বিষয় বিবেচনা নিয়ে হতে পারে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় দুর্নীতিই প্রধান সংকট৷ এছাড়া অন্যান্য দুর্নীতি তো আছেই৷ এগুলো শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেয়াই হলো আসল কথা৷ সবাই বলে কিন্তু করে না৷ তাই যারাই ক্ষমতায় যাক, তারা যদি প্রথমেই মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব এবং নির্বাচনি হিসাব প্রকাশ করে, যেন প্রথম পদক্ষেপ নেয়৷''
এদিকে ঐক্যফ্রন্টের যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার ঘোষণার ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা তো তাদের বিষয়৷ ওনারা ঘোষণা দিয়েছেন৷ আর বর্তমান সরকার দাবি করছে, ওনারা বিচার শেষ করেছেন৷ এখন পরবর্তীতে ওনারা কী করবেন সেটা ওনাদের বিষয়৷ আমাদের জানা মতে প্রাকটিক্যালি বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী ছিল না৷ যেটা বিচার হয়েছে, সেটা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ছিল৷ ওইটাকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার বলা হয়৷ বর্তমান সরকার দাবি করছে, ওটা শেষ৷ এখন ওনারা কী করবেন, সেটা আমাদের এখতিয়ারের বাইরে৷ তারপরও ওনারা ইশতাহারে রেখেছেন, সেটা ওনাদের বিষয়৷''