‘মশা আরো কমবে, তবে ঢাকাবাসীকেও সচেতন হতে হবে’
১২ মার্চ ২০২১ডয়চে ভেলে : আপনারা এত চেষ্টা করছেন, তারপরও কেন মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?
ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস : আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরই মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঢেলে সাজিয়েছি৷ আগের বছরগুলোতে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত৷ এডিস মশার কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল৷ আগে যেখানে এক ঘণ্টা মশক নিধনের কার্যক্রম চলতো, এখন সেখানে চার ঘণ্টা করা হয়েছে৷ সেভাবেই আমরা জনবল বাড়িয়েছি৷ এখন সকালে যারা কাজ করছেন, তারা শুধু সকালেই করছেন৷ বিকেলে যারা করছেন, তারা শুধু বিকেলেই করছেন৷ পুরো ৭৫টি ওয়ার্ডে সকালে আমরা আট জন করে দিয়েছি৷ বিকেলে প্রথম দফায় ১০ জন করে দেওয়া হয়েছিল, এখন সেটা পাঁচ জন করা হয়েছে৷ নগর ভবনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এটা মনিটরিং করছেন৷ ডেঙ্গু মশার বিরুদ্ধে আমরা যে কার্যক্রম নিয়েছি, তাতে আমরা সফল হয়েছি৷ ডেঙ্গুতে তেমন কোনো প্রাণহানি হয়নি৷
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে,গত বছরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মশার ঘনত্ব চার গুণ বেড়েছে৷ এটা কেন?
আমরা সর্বশেষ যে প্রতিবেদন পেয়েছি, সেটা ডেঙ্গুর উপরই হয়েছিল৷ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের বছরগুলোর তুলনায় একেবারেই কম৷ এডিস মশার বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমটা সফল হয়েছে৷ আমরা সমন্বিতভাবে কার্যক্রমটা নিয়েছি৷ আমাদের বাসা-বাড়ি বা ঘরের আশপাশে যে পানি জমে থাকে, সেখান থেকে এডিস মশা হয়৷ আর কিউলেক্স মশা বদ্ধ বড় জলাশয়ে হয়৷ এখনও ঢাকা শহরেআমাদের অনেক খাল ও জলাশয় রয়েছে৷ গবেষণা থেকে আমাদের বলা হয়েছিল, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যক্রমটা চলমান রাখতে৷ কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম, শীতকাল চলে গেলেও পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে কিউলেক্স মশার ব্যাপক প্রজনন হয়৷ এখন আমরা যে সূচি করবো, সেখানে এপ্রিল থেকে নভেম্বর এবং নভেম্বর থেকে এপ্রিল৷ কারণ, কিউলেক্স মশার প্রজনন হয়ে গেলে সেটার ব্যাপক বিস্তার হয়ে যায়৷ যেটা আমরা দেখেছি, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপক বিস্তার হয়েছে৷ এই মার্চে মশার প্রজনন ও বিস্তার কমে আসছে৷ আমরা আশাবাদী যে, আগামী সপ্তাহ থেকে আরো কমে আসবে৷ অন্য যে কোনো বছরের তুলনায়, আমাদের এখানে মশক এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ আমাদের যেহেতু অনেক খাল বা জলাধার আছে, সেই কারণে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে সুষ্ঠু ব্যাবস্থাপনা ও পরিকল্পনা নিতে হবে৷ খালগুলো পরিস্কার করার কাজ চলছে, এটা শেষ হলে ঢাকাকে পুরোপুরি মশকমুক্ত করা যাবে৷
আপনি তো গত জুন মাসে রমনা লেক, খিলগাঁওয়ের বটতলা ঝিলসহ তিনটি জলাশয়ে মশা মারতে তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছেড়েছিলেন৷ রমনা লেকের কিছু হাঁস এরই মধ্যে মরে গেছে৷ ফলে মশা মারার এই উদ্যোগ কতটা কাজে এসেছে?
বিশ্বব্যাপীই শুধুমাত্র কীটনাশকের উপর নির্ভর করে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম হয় না৷ এর জন্য সমন্বিত উদ্যোগের দরকার হয়৷ সে কারণে আমরা বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে সাজিয়েছি৷ আমি জানি না, কেন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টা তুলে ধরছেন না৷ সেটা হলো, আমাদের জীববৈচিত্রের যে ভারসাম্য, সেটা ঢাকা শহরে একদম ভেঙে পড়েছে৷ ৩০ বছর আগেও যেখানে লার্ভা ধ্বংসের মতো জীববৈচিত্র্য ছিল, এখন তা নেই৷ এজন্য জীব বৈচিত্রের ভারসাম্যটা বৃদ্ধি করতে হবে৷ শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না, এটা শারীরিকভাবে ও স্বাস্থ্যগতভাবে খুবই ঝুঁকির সৃষ্টি করে৷ এই কারণে আমরা হাঁস ও মাছ চাষ করছি৷ ১০টি জলাশয়কে আমরা ঠিক করেছি, সেখানে ভবিষ্যতে আমরা হাঁস ও মাছের পাশাপাশি ব্যাঙও চাষ করবো, যাতে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়৷
আপনার কী মনে আছে, শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আপনাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, মশা আপনাদের ভোট যেন খেয়ে না ফেলে?
প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যকেই আমরা শিরোধার্য হিসেবে নিয়েছি৷ করোনা মহামারির মাঝেও আমরা মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়েছি৷ এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো, কীটনাশক যখন দীর্ঘদিন প্রয়োগ করা হয়, তখন তাদের সহনশীলতাও বৃদ্ধি পায়৷ এজন্য আমরা কীটনাশকটা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছি৷ আশা করছি, আগামী সপ্তাহ থেকেই নতুন কীটনাশক ব্যবহার করতে পারবো৷ এর মাধ্যমে মশক আরো নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আমরা আশাবাদী৷
গত চার বছরে মশার পেছনে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যয় হয়েছে ৭৬ কোটি টাকা৷ তারপরও কেন মশার উপদ্রব কমছে না?
আমি ঢাকাবাসীর কাছেও এ বিষয়টি তুলে ধরতে চাই যে, আমরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করি মশক নিধনে, প্রচুর অর্থ ব্যয় করি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়৷ এটা সকলের নজরে আসা উচিত৷ মশক নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রায় এক হাজারের মতো জনবল প্রতিদিন কাজ করে৷ এর জন্য আমাদের ব্যাপক বেতনও দিতে হয়৷ আমাদের বেতনের একটা বড় অংশ কিন্তু এই মশক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ আমাদের খরচের একটা বড় অংশও মশক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷ সবাই যদি আমরা সচেতন হই যে, আশপাশ পরিস্কার রাখি, যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলি, জলাশয়গুলো যদি পরিস্কার রাখি তাহলে কিন্তু এত খরচ করতে হয় না৷ এখানে আমি ঢাকাবাসীকে এগিয়ে আসতে বলবো৷
যারা মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন, তাদের কীভাবে মনিটর করা হয়?
আমাদের যে সাংগঠনিক কাঠামো আছে, সেই অনুযায়ী তদারিক করা হয়৷ যে কর্মীরা ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন, তাদের দেখভালের জন্য একজন সুপারভাইজার আছে৷ তার উপরে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন৷ তার উপরে কাউন্সিলররা এটা তদারকি করে থাকেন৷ এর উপরে আমাদের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা আছেন৷ তার উপরে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আছেন৷ তাকে আমরা এটার দায়িত্ব দিয়েছি৷ তাছাড়া আমরা যারা কর্মকর্তা আছি, আমরা তো তদারকি করছিই৷ আমরা চেষ্টা করছি নিবিড়ভাবে তদারকি করার৷ তারপরও গাফিলতি থাকতে পারে৷ যখন যেগুলো নজরে আসে, তখনই ব্যবস্থা নিই৷
দীর্ঘদিন ধরেই মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ এখন যে ওষুধ আনতে চাচ্ছেন সেটার কার্যকারিতা কতটুকু পরীক্ষিত?
এটা তো সাধারণ কোনো কীটনাশক না৷ সরকারি কিছু নিয়মনীতি আছে, সেগুলো পরিপালন করেই ওষুধ আনতে হয়৷ কতটুকু ওষুধ প্রয়োগ করা যাবে সেটার সীমাও কিন্তু নির্ধারণ করা আছে৷ একটা নির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনেই এটার প্রয়োগ করতে হয়৷ বিশেষজ্ঞরা আমাদের সুপারিশ করেন, কখন কোন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে৷ তাদের মতামতের ভিত্তিতেই আমরা কীটনাশক আমদানি এবং প্রয়োগ করে থাকি৷ একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, আমরা কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই বাৎসরিক কীটনাশক একবারে এনে থাকি৷ কিন্তু দেশে আনার পর যদি দেখা যায়, সেই কীটনাশকে কাজ হচ্ছে না, তাখন কিন্তু আমরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হই৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকার কারণে মশার উপদ্রব কমছে না৷ আপনি কী মনে করেন?
আমাদের এখন যেভাবে কাজ হচ্ছে তাতে আমি মনে করি না যে, ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা আমাদের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর কার্যক্রম পরিচালনা করা৷ আমার মনে হয়, সেখানে একটু ভুল হয়েছে৷ বরং আমাদের সূচি অনুযায়ী যদি আমরা নভেম্বর থেকে কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম, তাহলে এ পর্যায়ে মশক এত বৃদ্ধি পেতো না৷ ভবিষ্যতে আমরা এই বিষয়টা অবশ্যই দেখবো৷
মাছ ও হাঁসের পর এবার আপনারা জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়তে যাচ্ছেন, এসব করে কী নগরবাসীর জন্য কোন সুখবর আপনি দিতে পারবেন?
আমি তো আগেই বলেছি৷ ঢাকায় জীব বৈচিত্র একেবারেই ভেঙে পড়েছে৷ জীববৈচিত্র রক্ষা পেলে আজকে মশক এ পর্যায়ে বৃদ্ধি পেত না৷ আমরা নিজেরাও ছোট বেলায় এগুলো উপলব্ধি করেছি৷ তখন কিন্তু মশকের পেছনে এত টাকা ব্যয় করতে হতো না৷ ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়াটা সমন্বিত রূপ পাবে তখন আমরা ফল পাবো৷ আজকেই কিন্তু এর ফল পাওয়া যাবে না৷ বহির্বিশ্বে যেহেতু এটা একটা পরীক্ষিত প্রক্রিয়া, তাই ভবিষ্যতে নিশ্চয় আমরা এটার ফল পাবো৷