বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতার সাফল্য ম্লান পেশাদার পর্যায়ে
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪৮ ডিসেম্বর যুব এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে ৫৯ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। যুব এশিয়া কাপের টানা দুই বারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, ২০২৩ সালের আসরেও ফাইনালে ওঠার পথে ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশের তরুণরা। কিন্তু সেই আসরের মাত্র মাসখানেক পর, দক্ষিণ আফ্রিকায় যুব বিশ্বকাপে ভারত হারিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। সেই আসরে ভারত হয় রানার্স আপ, বাংলাদেশ সুপার সিক্স পর্ব থেকেই ছিটকে যায়। এবারে দেখা যাক ভারতের সেই যুব দলের খেলোয়াড়দের পরবর্তী গন্তব্য। ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বকাপ খেলে দেশে ফেরার পর ভারতের তরুণ ক্রিকেটারদের খেলার সুযোগ হয় সি কে নাইডু ট্রফিতে খেলার। অনূর্ধ-২৩ বছর বয়সি ক্রিকেটারদের নিয়ে চারদিনের ম্যাচের এই টুর্নামেন্টের আবার দুটি ধাপ,লিগ এবং নকআউট। এর বাইরে ৫০ ওভারের একটি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আছে, অনূর্ধ ২৩ স্টেট এ ট্রফি। এই বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলো ছাড়াও আছে দুলিপ ট্রফি,ইরানি ট্রফি, রঞ্জি ট্রফি ও সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফির মতো প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ঘরোয়া আসর। সব কিছুর উপরে আছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। এই ধাপগুলো সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেই একজন ক্রিকেটার ভারতীয় দলে ডাক পান, তাই জাতীয় দলে আসতে আসতেই তার উচ্চ দক্ষতা ও পরিপক্কতা, পরিণতবোধ সবই চলে আসে। অন্যদিকে বাংলাদেশে একজন ক্রিকেটার যুব বিশ্বকাপে খেলার পর দুটো ব্যাপার ঘটে। কেউ দ্রুতই তারকা হয়ে জাতীয় দলে চলে আসেন এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপে হারিয়ে যান।কেউ জাতীয় দলের পরিসীমার বাইরে গিয়ে নিয়মিত অনুশীলন সুযোগ-সুবিধার অভাবে হারিয়ে যান। প্রক্রিয়া ভিন্ন হলেও পরিণতি প্রায় একই রকম। ২০২২ সালের অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলে খেলেছিলেন ইফতিখার হোসেন ইফতি। সেই আসরে শিরোপা ধরে রাখার প্রত্যয় নিয়ে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ দল ফিরেছিল সুপার লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় ভারতের কাছে। অনূর্ধ-১৯ দল থেকে বাছাই করা ক্রিকেটারদের নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একটি কর্মসূচি আছে, যার নাম হাই পারফর্ম্যান্স ইউনিট বা সংক্ষেপে এইচপি। সেই বিশ্বকাপের পর এইচপিতে জায়গা হয়নি ইফতেখারের,' আমরা ভালো ফল না করায় আমাদের দলের বেশিরভাগ বোলারকে এইচপিতে রাখে, ব্যাটসম্যানদের কাউকেই সেরকমভাবে এইচপিতে রাখে নাই।এরপর ধানমন্ডি একাডেমিতেই অনুশীলন করতাম, নিজেই করতাম। আমার বন্ধুরা যারা ভালো করেছিল, এইচপিতে সুযোগ পেয়েছিল, আমি পাইনি। এই নিয়ে আমার একটা জেদ ছিল যে, ঠিক আছে ওরা সুযোগ পেয়েছে তো কী হয়েছে, আমি আমার কাজটা করবো। আমি আমার কাজটা করে যাবো, আল্লাহ চাইলে উনি অবশ্যই দেবেন।' বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট প্রতিযোগিতা জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল) এর ২০২৪-২৫ মৌসুমে একটা সেঞ্চুরি ও ৫টা হাফসেঞ্চুরিসহ ৫৬৩ রান করে চতুর্থ সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হয়েছেন ইফতেখার। বিসিবির অধীনে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের পর ইফতেখার খেলেছেন দুই মৌসুম খেলেছেন ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে ( দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্তর), তাকে কোচিং করিয়েছেন স্থানীয় একটি ক্রিকেট ক্লাবের কোচরা।
বয়সভিত্তিক পর্যায়ের সঙ্গে পেশাদার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফর্ম্যান্সের বিস্তর ব্যবধানের উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই উঠে আসছে চারটা নাম। বাংলাদেশের মাহমুদুল হাসান জয়, তানজিদ হাসান তামিম ও ভারতের যশস্বী জয়সওয়াল ও তিলক বর্মা।এই ৪ ক্রিকেটারই ২০২০ সালের অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের
ফাইনালে, যে ম্যাচটায় ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্বকাপ জিতেছিল বাংলাদেশ। পচেমফস্ট্রমে সেদিন হেরে গেলেও জীবনের ইনিংসে ঠিকই এগিয়ে গেছেন যশস্বী এবং তিলক।
জয়ের টেস্ট অভিষেক ২০২১ সালে, যশস্বী ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন ২০২৩ সালে। যশস্বী টেস্ট খেলেছেন ১৬টি, জয় ১৭টি। যশস্বীর রান এখন ১৫৯২, ৪টা সেঞ্চুরি যার দুটো আবার ডাবল সেঞ্চুরি। নতুন প্রজন্ম, যার নাম দেয়া হয়েছে 'জেন-জি', এই সময়ের সেরা ৪ উদীয়মান ব্যাটসম্যানের একজন মনে করা হচ্ছে যশস্বীকে। আইপিএলের নিলামেই তাকে তুলতে দেয়নি রাজস্থান রয়্যালস, ১৮ কোটি রূপি খরচ করে তাকে দলে ধরে রেখেছে। অন্যদিকে জয়ের ১৭ টেস্টে ৭২৮ রান, একটা মোটে সেঞ্চুরি আর দুটো হাফসেঞ্চুরি। বাংলাদেশের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে ২ টেস্টের ৪ ইনিংসে তার রান যথাক্রমে ৫,৬,৩ ও ০। বিপিএলে ৩০টা ম্যাচ খেলেছেন জয়, করেছেন মাত্র ৫৯৬ রান। স্ট্রাইক রেট একশ'র একটু বেশি। সি ক্যাটাগরিতে থাকা জয়কে দলে নিতে খুলনা টাইগার্স খরচ করেছে ৩০ লাখ টাকা। বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলে নিয়মিত খেলেন তানজিদ হাসান তামিম। ২০টা ওয়ানডে, ১৫টা টি-টোয়েন্টি এরই মধ্যে খেলা হয়ে গেছে। যুব বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলা হয়ে গেছে তার। কোনো সংস্করণেই শতক নেই, পারফর্ম্যান্সও যে খুব বলার মতো এমন নয়। অন্যদিকে তিলক বর্মার ব্যাট কথা বলে সেঞ্চুরির ভাষায়! দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা দুটো সেঞ্চুরি করেছেন টি-টোয়েন্টিতে, এরপর দেশে ফিরে সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে আরো একটি! টানা ৩ টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি করা তিলক বর্মাকে ৮ কোটি রূপির বিনিময়ে ধরে রেখেছে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ, যাকে আগের মৌসুমে দিতে হয়েছিল মাত্র ১.৭ কোটি রূপি!
পারফর্ম্যান্স এবং অর্থের এই যে বিশাল 'বৈষম্য', তার পেছনে খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে আরো উঁচু মানে নিয়ে যেতে না পারার পেছনে তামিম বা জয়ের দায় অবশ্যই আছে, তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দায়টাও কম নেই। ২০০৮ সালে, আইপিএলের সূচনালগ্নেই আইপিএল কর্তৃপক্ষ একটা নিয়ম করেছিল যে প্রতিটা ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে ২ জন করে অনূর্ধ-১৯ দলের ক্রিকেটার দলে নিতেই হবে। তাদের জন্য পারিশ্রমিকটাও ছিল বেঁধে দেয়া, মূল লক্ষ্য ছিল তরুণদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেয়া। যেই নিয়মের মাধ্যমেই ২০০৮ সালে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ২০০৮ সালে দলে নিয়েছিল যুব বিশ্বকাপ জিতে আসা বিরাট কোহলিকে,এরপর থেকে সেই জুটি এখনো অবিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশে এমন কোনো নিয়ম তো নেই, আর হবেই বা কোথা থেকে বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিই তো বদলায় বছর বছর। চেন্নাই সুপার কিংস, রাজস্থান রয়্যালস এসব দলের নিজস্ব একাডেমি আছে, বাংলাদেশের বিপিএল দলগুলোর নিজস্ব অফিসও নেই! বিসিবির নিজস্ব যে পরিচর্যা ব্যবস্থা, যার নাম হাই পারফর্ম্যান্স ইউনিট, দীর্ঘদিন এই ইউনিটটি পরিচালিত হয়েছে সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দূর্জয়ের হাতে। রাজনীতি এবং সাবেক ক্রিকেটারদের সংগঠন ' ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব)' নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া সাবেক অধিনায়ক এদিকে নজর দিয়েছেন কমই। যুব বিশ্বকাপ জিতে আসা দলটাকে নিয়ে বিশেষ কোনো কার্যক্রম, গালভরা প্রতিশ্রুতি দেয়া নাজমুল হাসান পাপন ও খালেদ মাহমুদ সুজন কেউই এখন বিসিবিতে নেই। তবে তারা থাকতেও আর্থিক পুরষ্কারের বাইরে খুব বেশি কিছু করেছেন তা-ও নয়। কোভিড ১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিশ্বকাপ জয়ের পর দেশে এসে পর্যাপ্ত খেলা ও অনুশীলনের সুযোগও পাননি তরুণ ক্রিকেটারারা।
বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান এবং আইসিসির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বুলবুল জানিয়েছেন কেন বয়সভিত্তিক সাফল্যের পুঁজিকে পরবর্তীতে কাজে লাগাতে পারে না বাংলাদেশ, ' আমরা গর্বিত, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল এশিয়া কাপ জিতেছে। তারা গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত সব ফুল মেম্বার দলকে হারিয়ে এই অর্জন নিশ্চিত করেছে। এটি একটি বিশাল সাফল্য। অভিনন্দন! আমরা ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপও জিতেছিলাম এবং প্রমাণ করেছি যে বাংলাদেশি অনূর্ধ্ব-১৯ দল বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অন্যতম সেরা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের সিনিয়র ক্রিকেট দল এখনও কোনো এশিয়া কাপ, বিশ্বকাপ বা বড় কোনো আইসিসি ইভেন্ট জিততে পারেনি—ফাইনালে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তিন ফরম্যাটেই আমাদের র্যাংকিং গড়ের নিচে। কেন এই বড় ফারাক? এই দুই সাফল্যের মধ্যে যে বড় শূন্যতা তা পূরণ করার জন্য প্রয়োজন সঠিক যত্ন এবং কার্যকর হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) সিস্টেম প্রতিষ্ঠা। উন্নত দলগুলো যেখানে বিনিয়োগ করছে সঠিক জ্ঞান দিয়ে, আমাদের সেখানে ঘাটতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
১. সাপোর্ট স্টাফের উন্নয়ন প্রক্রিয়া
২. কোচদের প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ
৩. ট্যালেন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়া
৪. স্পোর্টস সায়েন্স এবং মেডিসিনের ব্যবহার
৫. সুবিধাসম্পন্ন অবকাঠামো এবং প্রতিযোগিতামূলক ঘরোয়া ক্রিকেট
৬. সমন্বিত ক্রিকেট বিভাগ
আমাদের এগুলোর প্রতিটির প্রতি ধাপে ধাপে বিনিয়োগ এবং বাস্তবায়ন করা উচিত।
আমাদের এই বিশ্বমানের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের হেলায় নষ্ট করে দেওয়া যাবে না।
হয়তো কথাগুলো শুনতে কঠিন লাগতে পারে, কিন্তু আমাদের অহংকার সরিয়ে সঠিক জ্ঞান এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করতে হবে। অর্থ কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হল সঠিক পরিকল্পনা এবং সততার অভাব। যদি আমরা এখনই এগুলো না করি, তাহলে এই সাফল্যের ধারাকে হারিয়ে ফেলব। আর ভবিষ্যতে শুধুই গর্ব করতে হবে যে আমাদের ব্যাংকে নির্ধারিত আমানতে টাকা জমা আছে', ফেসবুকে এমনটাই লিখেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এই সাবেক ক্রিকেটার।
যুব বিশ্বকাপ জয়ের পরও অনেক অধিনায়কই পরে আর জাতীয় দলেও আসতে পারেননা। ভারতের উন্মুক্ত চান্দ খুর সম্ভবত পথ হারিয়ে ফেলা প্রতিভার বড় উদাহরণ, ভারত ছেড়ে যার ঠিকানা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আকবর আলীও দেখছেন একে একে অনেক সতীর্থকেই জাতীয় দলে খেলতে। সুযোগ পাচ্ছেন না, ঘরোয়া পারফরম্যান্সও খুব আশানরূপ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে জাকের আলি অনিক, মাহিদুল ইসলাম অঙ্কনের অভিষেক হয়েছে। এই জায়গাটা হতে পারত আকবরেরও। কিন্তু নির্বাচকদের নজর কাড়ার জন্য যে রানটা তাকে করতে হবে, বিপিএল হোক কিংবা জাতীয় লিগ; কোথাও যে তার এমন কোন সাফল্য নেই।
বাংলাদেশ অনূর্ধ-১৯ দলের কোচ নাভেদ নাওয়াজ। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এই শ্রীলঙ্কানের হাত ধরেই ২০২০ সালে আকবরদের দলটা বিশ্বকাপ জিতেছিল। পরের যুব বিশ্বকাপেও তিনিই ছিলেন কোচ, কিন্তু দল ভাল না করায় বিসিবি তার চুক্তি বাড়াতে আগ্রহী হয়নি। নাভেদও শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের সহকারী কোচের চাকরি পেয়ে চলে গিয়েছিলেন। এই বছর নাভেদকে আবারও নিয়ে আসা হয়েছে পুরানো দায়িত্বে। প্রাথমিকভাবে খেলোয়াড় বাছাই শেষে আরব আমিরাতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে একটা সিরিজ খেলে এশিয়া কাপে গিয়েই বাংলাদেশের যুব দল হারিয়েছে পাকিস্তান ও ভারতকে। অর্জনটা নিঃসন্দেহে বড়, তবে নাভেদ জানিয়েছেন এখনো পাড়ি দিতে হবে বহু পথ। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে শিরোপা বা সাফল্যের চেয়ে ভবিষ্যতের জন্য ক্রিকেটার তুলে আনাটাই গুরুত্বপূর্ণ, তবে উদ্যোগটা হতে হবে সমন্বিত, ' আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কঠিন জায়গা। সে পর্যন্ত যেতে যেতে অনেক কিছুই হতে পারে। বয়সভিত্তিক পর্যায়ের ক্রিকেটাররা ওই পর্যায় গিয়ে কেন নিজেদের ধরে রাখতে পারে না, তার কারণ ও সমাধান খুঁজে বের করাটা জরুরি। গ্যাপটা কোথায় তৈরি হচ্ছে—ফিটনেসে, কোচিংয়ে নাকি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায়, আমাদের তার উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। আমি মনে করি সব আন্তর্জাতিক দলের জন্যই তাদের ঘরোয়া ক্রিকেট শক্তিশালী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু ভালো খেলোয়াড় উঠে আসার জন্যই নয়, মানসম্মত কোচিংয়ের জন্যও জরুরি। আমি নিশ্চিত বিসিবি এদিকটা দেখবে। উন্নত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলোয়াড়দের আরও দৃঢ় করে তোলে। ঘরোয়া প্রতিযোগিতা যদি মানসম্মত না হয়, তা থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের ওপরও আপনি আস্থা রাখতে পারবেন না। একই কথা প্রযোজ্য কোচিংয়ের ক্ষেত্রেও। একজন খেলোয়াড়কে ভালোভাবে গড়ে তুলতে, তার শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার জায়গা বুঝতেও ভালো কোচিংটা জরুরি। আমি মনে করি দুটো লক্ষ্যই থাকা উচিত। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট জয়ের লক্ষ্য যেমন রাখতে হবে, একইভাবে এমন কিছু ক্রিকেটার তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ, যারা বাংলাদেশ দলের হয়ে লম্বা সময় খেলতে পারবে। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বললে এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আসলে', বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন নাভেদ।
সাংগঠনিক দিক দিয়ে বিসিবি'র যেমন ব্যর্থতা আছে, তেমনি অপ্রস্তুত ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঠেলে দেয়ার নজিরও আছে নির্বাচকদের। মিনহাজুল আবেদীন নান্নু'র নেতৃত্বাধীন নির্বাচক কমিটি ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ২০২০ সালের অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে খেলা শামীম হোসেন পাটোয়ারিকে। মাত্র ৭ ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়েই বিশ্বকাপে চলে যান শামীম, বিশ্বকাপের আগে খেলা ৫ ম্যাচের একটিতে ব্যাট করেননি আর বাকি ৪ ইনিংসে রান ছিল ৪,৩,৩,২! বিশ্বকাপে গিয়ে ৩ ম্যাচে অবশ্য এর চেয়ে ভালো করেছিলেন, ১১,১৯ ও ২২! কিন্তু যে ফিনিশারের বিজ্ঞাপণ দেখিয়ে তাকে নেয়া, সেই ভূমিকায় অকার্যকর। তাই তো এরপর বছর দেড়েক জাতীয় দলে সুযোগই পাননি শামীম। তানজিদ হাসান তামিমকেও মাত্র ৫ ওয়ানডে খেলিয়ে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়া হয় ২০২৩ সালে, সেখানে ৯টা ম্যাচেই খেলেছেন তামিম। পারফর্ম্যান্সের জোরে নয়, দলে আর কোনো উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান না থাকায়! এর বাইরে গণমাধ্যমের দায়টাও বোধহয় একেবারে কম নয়। অল্প বয়সেই তারকাখ্যাতি পেয়ে যাওয়ার সুবাদে অনেক ক্রিকেটারই যে খেই হারিয়ে ফেলেন, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ভারতের পৃথ্বী শ।
বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় নির্বাচকদের একজন হান্নান সরকার। একসময় ছিলেন বয়সভিত্তিক দলেরও নির্বাচক। সাবেক এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তাই আকুল আবেদন করে ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন, '‘‘যে খেলোয়াড়টিকে নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা, অনূর্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিম। চমৎকার ক্রিকেট খেলেছে (এনসিএল টি-২০তে ৩১ বলে ৫৩) আমরা তার কাছ থেকে যেমনটা প্রত্যাশা করি, সেরকম ক্রিকেটই খেলেছে। আমি বা আমরা যখন অনূর্ধ-১৯ ক্রিকেট খেলি এরপর আমি বা অনেকেই কিন্তু হারিয়ে গেছে, কারণ, একটা সময়ে আমাদের ক্ষুধা কমে গিয়েছিল। যে কারণে পারফর্ম্যান্সও কমে গিয়েছিল। এটা হয়, যখন অনূর্ধ-১৯ পর্যায়ে ভাল করে ফেলি, মানুষের মুখে মুখে নাম চলে আসে তখন পারফরম্যান্সের বাইরেও অনেক দিকে মনোযোগ চলে যায়। তামিমের জন্য পরামর্শ থাকবে সে যেন দিকভ্রষ্ট না হয়,মনোযোগ থাকে। একাগ্রতাটা থাকে। ক্যারিয়ারটা মাত্র শুরু হলো, ১৫-২০ বছর ক্রিকেট খেলতে হলে ক্ষুধাটা সবসময় থাকতে হবে'। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে এসে চটজলদি সাফল্যের পর হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশেও কম নেই। অভিষেক টেস্টেই রেকর্ড গড়া শতক করা মোহাম্মদ আশরাফুলই তো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ভারতের অনূর্ধ-১৯ দলের কোচ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। বেঙ্গালুরুতে জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে সনদপ্রদান অনুষ্ঠানে দ্রাবিড় বলেছিলেন,' জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে একটি ক্যাম্প শেষে সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘‘বেশি খেলাই অভিজ্ঞতা নয়। অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভুল থেকে শিখে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা। তোমরা তরুণ। তোমাদের সামনে দীর্ঘ পথ। সবই স্মৃতি আর শিক্ষা। এখানে ভালো বা খারাপ বলে কিছু নেই। কেউ ১৫ বছরে সফল হয়েছে তার মানে এই নয় যে, সে ১৯ বছর বয়সেও সফল হবে। কেউ ১৯ বছর বয়সে সফল হলেই যে সে ২৩ বছর বয়সে সফল হবে এমনটা মোটেও নয়। ২৩-এ সফল হলেই এর মানে এই নয় যে ২৫ বছর বয়সেও সফল হবে। পার্থক্যটা গড়ে দেয় চাপ নেওয়ার ক্ষমতা, নতুন করে শেখার সামর্থ্য।''
ক্রিকেট বা যে কোন খেলায় বয়সভিত্তিক পর্যায়টা হচ্ছে মূলত শেখার, অভিজ্ঞতা অর্জনের। এখানে শিরোপা জেতা অবশ্যই কৃতিত্বের, তবে সেটাই শেষ কথা নয়। তার প্রমাণ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। যুব বিশ্বকাপের সফলতম দল ভারত, তারা ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন আর ৪ বারের রানার্স আপ। অস্ট্রেলিয়া যুব বিশ্বকাপ জিতেছে ৪ বার। অথচ ওয়ানডে বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ৬ বার, ভারত মাত্র ২ বার। টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি; তিন সংস্করণেরই বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, আছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও। কারণ শুধু প্রতিভা অন্বেষণ নয়, প্রতিভাবানদের দক্ষ পেশাদারে পরিণত করার অবকাঠামোটাও আছে অস্ট্রেলিয়ার, যেটা নেই বাংলাদেশে।