বাংলা বাধ্যতামূলক করা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে
১০ আগস্ট ২০২৩বাংলা মাধ্যম স্কুলে বাংলাই প্রথম ভাষা হিসেবে পড়ানো হয়। এ রাজ্যের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। চলতি সপ্তাহে রাজ্য মন্ত্রিসভায় যে নয়া শিক্ষানীতির খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, তাতে ওই অভিযোগ নিরসনের একটা উদ্যোগ চোখে পড়েছিল।
এই খসড়া নীতি প্রকাশ্যে আসতে সমালোচনা শুরু হয়। রাজ্য সরকার বাংলা চাপিয়ে দিতে চাইছে বলে অভিযোগ ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী বুধবার জানিয়েছেন, কারো উপর কোনো ভাষা 'চাপিয়ে দেয়া' হবে না। এর ফলে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে আগের পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না।
গত এপ্রিলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই অনুসারে রাজ্যের শিক্ষানীতি তৈরির জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়। এই কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি হয়েছে রাজ্যের শিক্ষানীতির খসড়া। এই খসড়া বিলের আকারে রাজ্য বিধানসভায় পেশ করা হবে। তারপর সেটি আইনে পরিণত হবে।
এই খসড়ায় বলা হয়েছে, যে সব পড়ুয়ার প্রথম বা দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়, তাদের জন্য প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাষা হিসেবে বাংলার পৃথক পাঠ দেয়া হবে। তাহলে কি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সব পড়ুয়াকে বাংলা পড়তেই হবে, এই প্রশ্নে শুরু হয় বিতর্ক। বাংলা 'চাপিয়ে দেয়ার' অভিযোগ ওঠে।
রাজ্যের ব্যাখ্যা
সোমবার নয়া শিক্ষানীতির খসড়া বিধানসভায় অনুমোদিত হয়েছিল। তার পরের দিনই এ নিয়ে অস্পষ্টতা কাটানোর চেষ্টা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তার বক্তব্য, "আমরা ত্রি-ভাষার কথা বলেছি। বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেয়া হবে না। যে এলাকায় যেটি প্রথম ভাষা হিসেবে রয়েছে, সেটিই প্রাধান্য পাবে।"
বাংলা পক্ষের মতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন এতে উৎসাহিত হয়েছিল। যদিও বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিতর্ক কাটাতে বলেন, "কেউ কেউ ভাষা নিয়ে উল্টোপাল্টা বকছে। আমরা তিন ভাষার ফর্মুলা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমে থাকবে মাতৃভাষা। যারা অলচিকিতে পড়ে, তাদের প্রথম ভাষা হবে অলচিকি। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা রাখতে পারে। যেমন দার্জিলিংয়ে নেপালি ভাষায় অনেকে পড়ে। ওটাই ওদের প্রথম ভাষা। তাই কারো উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।”
বাংলা নিয়ে দাবি
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, বাংলা ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক কি হচ্ছে না? বাংলা ভাষার পাঠ না নেয়ার স্বাধীনতা থাকবে অন্য মাতৃভাষার পড়ুয়াদের? যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না বলে মনে করেন বাংলা পক্ষের সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায়।
গর্গ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের অন্যান্য ভাষাভিত্তিক রাজ্যে সেখানকার ভাষা পড়া বাধ্যতামূলক। উত্তরপ্রদেশ, বিহারে হিন্দি, তামিলনাড়ুতে তামিল, গুজরাতে গুজরাতি, ওড়িশায় ওড়িয়া পড়তে হবে। এখানে সেই চেষ্টা হলে কেন 'চাপিয়ে দেয়া' বলা হবে?"
নেতাজি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডলও 'চাপিয়ে দেয়া'র তত্ত্ব মানতে রাজি নন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে সব প্রদেশ নিয়ে ভারত তৈরি হয়েছে, সেই প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেখানকার ভাষা গুরুত্ব পাবে, এটা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। এটাকে যদি বলা হয় 'চাপিয়ে দেয়া' হচ্ছে, তা হলে সেটা জাতীয় নীতির বিরোধী হয়ে যায়।"
প্রাথমিকের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষাতেও এর প্রভাব পড়বে। মনন বলেন, "উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষার উপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রথম ভাষা হিসেবে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা না পড়ে, তা হলে বিজ্ঞান বা মানববিদ্যার বই অনুবাদ করে কী হবে?"
অতীতেও বাংলা বাধ্যতামূলক করার রব উঠলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। গর্গ এর জন্য রাজনীতিকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের শাসক ও বিরোধী দলগুলি বহিরাগত তোষণে ব্যস্ত। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি চলছে। তাই গেজেট নোটিফিকেশন ছাড়া বাংলা বাধ্যতামূলক করার কথা বাঙালি বিশ্বাস করবে না। এর আগেও এই আলোচনা হয়েছে, যা অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে।"
শিক্ষাতেও কমিশন
নতুন খসড়া নীতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক শিক্ষা কমিশন গঠন। এর আগে বেসরকারি হাসপাতালের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে রাজ্য সরকার স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করেছিল। এবার মন্ত্রিসভা 'ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট স্কুল রেগুলেটরি কমিশন বিল ২০২৩'-এ অনুমোদন দিয়েছে।
বেসরকারি স্কুলের ফি নিয়ে অভিভাবকদের বিস্তর অভিযোগ থাকে। করোনা অতিমারির পর্বে এ নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা হয়েছিল। এই কমিশন ফি ছাড়াও স্কুল সংক্রান্ত অন্যান্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। বিল অনুযায়ী, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে মাথায় রেখে কমিটি তৈরি করা হচ্ছে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও, বেসরকারি স্কুল যে বোর্ডগুলির অধীনে, তার প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
গ্রামে পড়ানোর ডাক
অনেক সময় দেখা যায় গ্রামের বিভিন্ন সরকার পোষিত স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। বর্তমানে নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে থাকায় এই সঙ্কট আরো বেড়েছে। শিক্ষানীতির খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক শিক্ষককে বাধ্যতামূলকভাবে পাঁচ বছর জেলায় পড়াতে হবে।
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বেশিরভাগ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী গ্রামেই আছেন, শহরে ক'টা স্কুল আছে? আবার অনেকে চাইছেন নিজের জেলার স্কুলে কাজ করতে। তা কীভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব, সেটা সরকারকে দেখতে হবে।"