প্রতিবাদ করলেই দেশদ্রোহী
১১ জুন ২০১৯উত্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নামে একটি আপত্তিকর ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করার অপরাধে গত দুদিনে ওই রাজ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনজন সাংবাদি৷ বিতর্কিত ওই ভিডিওটি প্রশান্ত কানোজিয়া নামে এক মুক্ত সাংবাদিক শেয়ার করেন টুইটারে। ‘নেশন লাইভ' নামে একটি টিভি চ্যানেলের দুই সংবাদকর্মী ঈশিতা সিং ও অনুজ শুক্লা সেটি টিভিতে দেখান। এঁদের তিনজনকেই মানহানির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে সেই মামলার শুনানি। এই সরকারি আচরণ একটাই বার্তা দিচ্ছে— বর্তমান প্রশাসক কতটা অসহিষ্ণু!
এক বছর আগে মহারাষ্ট্র সরকার ভীমা–কোরেগাঁও জাতিদাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল পাঁচ বুদ্ধিজীবীকে। আইনজীবী সুরেন্দ্র গাডলিং, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা সোমা সেন, কবি–প্রকাশক সুধীর ধাবালে, এবং দুই মানবাধিকার কর্মী মহেশ রাউত এবং রোনা উইলসন–কে৷ এরা পাঁচজনেই এখনও বিনা বিচারে আটক আছেন পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে। ছ'মাসের মাথায় এঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট যদিও আদালতে জমা দিয়েছিল পুণে পুলিশ, কিন্তু তাতে আনা অভিযোগের সপক্ষে কোনও সাক্ষ্য–প্রমাণ গত এক বছরেও দাখিল করতে পারেনি। তাঁদের জামিনের আর্জিরও শুনানি হয়নি৷ যাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, ‘এলগার পরিষদ' নামে আদিবাসী ও দলিতদের অধিকার রক্ষার একটি মঞ্চ থেকে দেওয়া ভাষণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন জোগানোর৷
ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে কলকাতায় হল একটি সম্মেলন, তৈরি হল ‘প্রতিবাদের অধিকার মঞ্চ', যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য— স্বাধীন মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখা৷ মহারাষ্ট্রে বিনা বিচারে আটক ওই পাঁচ বুদ্ধিজীবীর বিষয়টি পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক করে তুলেছে বলে মনে করছেন মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক রবীন চক্রবর্তী৷ তিনি আতঙ্কিত, যে এরকম বহু সমাজকর্মীই এখন সরকারের হিট লিস্টে আছেন৷ অথচ এদের কাজ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এরা কেউ সরকারের বিরোধিতা নয়, বরং সামাজিক আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। কাজেই প্রতিবাদ করার অধিকার নিয়ে একটা সার্বিক সচেতনতা প্রচার করতেই তাঁরা বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে কলকাতায় সম্মেলনটির আয়োজন করেছিলেন৷
সরকারি নীতির বিরোধিতা করলেও এখন শাস্তি পেতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলে–কে রবীন চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে৷ তার বিরুদ্ধে বলাটা যদি সরকার বিরোধিতা হয়ে যায়, তা হলে আরও সর্বনাশ৷ মানে সরকার একটা নীতি নিয়েছে, তার বিরোধিতা করলে সরকার ভাববে যে আমি তার বিরোধিতা করছি৷ কিন্তু মানুষের যে ন্যুনতম অধিকার, সেটা খণ্ডিত হলে— সেটা বললেও যদি সরকার বিরোধিতা হয়, তা হলে সেটা কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষণই নয়!' তবে সরকার পক্ষ এখন যে ভাবে প্রচার চালায়, যে বিপুল তার লোকবল এবং অর্থবল, যেভাবে সত্যি খবরকেও প্রচারের তোড়ে ভুয়ো বলে প্রমাণ করে দেওয়া হয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা যে নেই, সেটাও স্বীকার করে নিচ্ছেন রবীন চক্রবর্তী৷ এ জন্য তিনি কিছুটা দায়ী করছেন আজকের বামপন্থীদের শত্রু চিহ্নিত করার ভুল প্রক্রিয়াকে, আর নবীন প্রজন্ম এই বাকস্বাধীনতা রক্ষায় সতর্ক এবং সচেতন না হওয়াকে৷
যদিও ‘প্রতিবাদের অধিকার মঞ্চ'–র একই সম্মেলনে অংশ নেওয়া নবীন সমাজকর্মী রজত শূর এই দায় পুরোপুরি নিতে রাজি হলেন না। ডয়চে ভেলে–কে রজত বললেন, ‘আমাদের সময়ের সংকটটা অনেক বেশি এবং আমাদের চাহিদাগুলোও পাল্টে যায়। স্বাভাবিকভাবেই সকলকে চাকরিবাকরি পেতে হবে। সেক্ষেত্রে কিছু বাধা–বিপত্তি যখন তৈরি হচ্ছে, সেই জন্যে যদি একটা অংশ একটু ভয় পেয়ে থাকে, সেটাও বোধহয় অন্যায় কিছু নেই৷'
আসলে রবীন চক্রবর্তী একটা কথা বলেছেন, যে ওঁদের সম্মেলনে বয়স্ক, রীতিমত প্রবীণ, সত্তরোর্ধ পক্ককেশ মানুষের সংখ্যাই বেশি ছিল৷ রজতও মেনে নিয়েছেন, যে একটা পথসভা করতে হলেও সেভাবে লোক পাওয়া যায় না৷ ফলে প্রতিবাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা হলেই যে বহু মানুষ সাহস পেয়ে, উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসবেন, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না৷ সেক্ষেত্রে একটাই প্রশ্ন। তা হলে সমাজে, দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের দায়িত্ব নেবে কে? কতদূর সে অধিকার লঙ্ঘিত হলে, তবে মানুষের মনে হবে, যথেষ্ট হয়েছে?