বিজেপির উত্থানে সংখ্যালঘুদের অবস্থান
৬ জুন ২০১৯ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফল নিয়ে বাড়তি কৌতূহল ছিল। অনুমান সত্যি করে এই রাজ্যে আশ্চর্য উত্থান হয়েছে বিজেপির। ৪২ আসনের মধ্যে ১৮টি আসনে জিতেছে তারা। সেই ধাক্কায় রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা নেমে এসেছে ২২-এ। শুধু আসনের বিচারে নয়, প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে তৃণমূলের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে প্রায় ১৩০টিতে এগিয়ে আছে তারা। এই ফলের পর জোর আলোচনা চলছে তবে কি ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবে গেরুয়া শিবির।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে কি না, তা পরে জানা যাবে। কিন্তু, লোকসভা ভোটে তাদের উত্থান আরও একটি জরুরি প্রশ্ন সামনে এসেছে। সেটা হল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা। ভারতের যে সব প্রদেশে মুসলিমদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, তার মধ্যে অন্যতম এই বাংলা। দেশে তাদের সংখ্যা মোট জনসমষ্টির ১৫ শতাংশের কম হলেও পশ্চিমবঙ্গে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। এমন একটি রাজ্যে বিজেপির অগ্রগমন অনিবার্য প্রশ্নটি তুলে ধরেছে, সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কি এখানে নিরাপদ? এর উত্তরে সবাই গেল গেল রব তুলতে রাজি নন।
অনেকেই বাংলার পরম্পরার উপর ভরসা রাখছেন, যেখানে ধর্মের থেকে সংস্কৃতি বেশি গুরুত্ব পায়। বাংলা থেকে উর্দুতে অনুবাদের কাজ করেন সাবির আহমেদ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "সেই সময়” উপন্যাস অনুবাদ করেছেন তিনি। সাবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের রাজ্যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হয় না। এখানে সংস্কৃতির জোর অনেক বেশি। মৌলবাদী শক্তি পশ্চিমবঙ্গে তাই কখনও দাঁত ফোটাতে পারেনি। তাই এখানে ধর্ম দিয়ে বিভেদ তৈরি করা এত সহজ নয়।” একই মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক শিবাজিপ্রতীম বসুর। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমাদের রাজ্যে সবাই মিলেমিশে থাকে। দেশের অন্যত্র হিংসা হলেও এখানে তার আঁচ পড়ে না। তাই বিজেপির শক্তি বাড়ায় পশ্চিমবঙ্গে দুই সম্প্রদায় লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে, এটা ভাবা ঠিক নয়।”
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। সেখানেও রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এই রাজ্যগুলিতে বড়সড় গন্ডগোল হয়নি বটে। তবে গুজরাত থেকে আসাম, সরকারি নানা কাজকর্মে হিন্দুত্বের প্রভাব স্পষ্ট। গো-বলয়ে গো-রক্ষকদের দাপাদাপিও বেড়েছে। বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস আছে, এই সন্দেহে উত্তরপ্রদেশে মহম্মদ আখলাককে মারা হয়েছে। বিজেপি সরকার এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করলেও তা সংখ্যালঘুদের মনে কি আতঙ্ক তৈরি করে না? প্রাক্তন সাংসদ, প্রবীণ রাজনীতিক সর্দার আমজাদ আলির মতে, এতে ভয় তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এখনই সেই ভয়ের কারণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিজেপি এখানে শক্তি বাড়িয়েছে, এটাই সব নয়। তারা কীভাবে প্রচার চালাচ্ছে, সেটা বিচার করা জরুরি। বিজেপি জয় শ্রীরাম স্লোগান সামনে রেখেছে। একটা বিশেষ ধর্মের মানুষকে কাছে টেনে মেরুকরণের জন্য একে রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ থাকতেই পারে।”
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনে জয়লাভের পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, সবার সঙ্গে সবার উন্নয়নের স্লোগানে তিনি এ বার সবার আস্থা অর্জনকেও জুড়তে চান। পর্যবেক্ষকদের মতে, এর মাধ্যমে দেশের মুসলিমদের বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের কিছুটা সমর্থনও এ বার বিজেপি পেয়েছে। নইলে দেশের মুসলিম অধ্যুষিত ৯০টি জেলার ৭১টি আসনের মধ্যে ৪১টিতে বিজেপি জয় পেত না। সম্ভবত মোদী সরকারের তিন তালাক প্রথা বাতিলের উদ্যোগ সংখ্যালঘু মহিলাদের প্রভাবিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সবার আস্থা অর্জনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সর্দার আমজাদ আলি। তাঁর বক্তব্য, "বিজেপি যদি সত্যিই সংখ্যালঘুদের কাছে টানতে চাইত তাহলে তাদের আরও বেশি সংখ্যায় প্রার্থী করত, তাদের জিতিয়ে আনত লোকসভায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বেশি থাকত। শুধু সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের ভার দেওয়া হয়েছে একজনকে। এটা থেকে সদিচ্ছার প্রমাণ মেলে না।”
পশ্চিমবঙ্গে ভবিষ্যতে যদি মেরুকরণ তীব্রতর হয়, বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তাহলেও দুই সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। সাবির আহমেদের বক্তব্য, "বাংলায় সাংস্কৃতিক চেতনা প্রখর। ধর্মের উপরে তার জায়গা। তাই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর ভাষার দাবিতে ভেঙে গিয়েছে। বাঙালির কাছে ইসলামের থেকে মাতৃভাষা, সংস্কৃতি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও তাই ধর্ম নিয়ে বিবাদ বড় আকার নেবে না।” এতটাই আশাবাদী শিবাজীপ্রতিম বসুও। তাঁর মতে, "হিন্দুত্বের বোধ জাগানোর চেষ্টা করা হলেও গোবলয়ের মতো ধর্মান্ধতা এখানে নেই। ধর্ম নিয়ে মাতামাতি ভোটের ফলে প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু, তাতে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হবে না। তাছাড়া প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষের ভালোমন্দ উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যাবে না, এটা বিজেপি নেতৃত্বও জানেন।”