মোদীর বাধা গো-রক্ষকরা
৩০ মে ২০১৯হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সাধারণ নির্বাচনে বিরাট জয় পেয়েছে৷ গতবারের থেকেও বেশি আসনে জিতেছে বিজেপি তথা এনডিএ৷ জনকল্যাণের কর্মসূচি, না সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, কিসের জোরে এই সাফল্য মোদীর, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে৷ এই জয়ের গন্ধ পেয়েই গো-রক্ষকরা মাঠে নেমে পড়েছিল৷ ২২ মে মধ্যপ্রদেশে এক মুসলিম মহিলাহ চার জনকে বেধড়ক মারধর করা হয়৷ তাঁদের অপরাধ, তাঁরা একটি অটো রিকশায় মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন৷ সেটিকে গোমাংস ভেবেছিল শ্রীরাম সেনার সদস্যরা৷ তারা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে লাঠি দিয়ে ব্যাপক মারধর করে কয়েকজনকে৷ ২৩ মে ফল প্রকাশের একদিন পর এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসে৷অনেকের আশঙ্কা, মোদী বাহিনী বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকারে ফেরায় এই ধরনের ঘটনা আরো বাড়বে৷ গেরুয়া শিবিরের পাল্টা দাবি, এ সব কাজে বিজেপির অনুমোদন নেই৷ এটা সমাজবিরোধীদের কাজ৷
গো-রক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে গত কয়েক বছরে ভারতে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে৷ ফ্রিজে গোমাংস রাখার জন্য মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে৷ এই ঘটনায় সমালোচনা তুঙ্গে উঠেছিল৷ এরপর গো-রক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন, ধরপাকড়ও হয়েছে৷ কিন্তু, তাদের কার্যকলাপে ছেদ পড়েনি৷ বিজেপি বরাবরই গো-রক্ষকদের তাণ্ডবের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে৷ যেমন এ বারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী, প্রাক্তন আমলা পরেশচন্দ্র দাস ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এসব কাজকে আমরা সমর্থন করি না, যদিও এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়৷ প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে৷’’ এটাকে নিছক আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা ভাবলে ভুল হবে, আদতে এই বাহিনী একটি উগ্র মৌলবাদী মতাদর্শকে সামনে রেখে তৎপরতা চালায় বলে মত রাজনীতির বিশ্লেষকদের৷ পরেশের বক্তব্য, ‘‘গো-রক্ষকরা কেউ বিজেপির সদস্য নয়৷ এই সংগঠনগুলি বিজেপির অনুমোদিতও নয়৷ এরা সব স্বঘোষিত গো-রক্ষক সংগঠন৷ এদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷’’
গো-রক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের নিশানা করা হচ্ছে৷ বলা ভালো, সেটাই এই দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য৷ অথচ নির্বাচনে জয়ের পর, ২৩ মে সন্ধ্যার ভাষণে মোদী বলেন, তিনি সকলের সঙ্গে সকলের উন্নয়নের বার্তা দিয়েছিলেন, এবার তাঁর সঙ্গে জুড়তে চান সকলের আস্থা অর্জনকে৷ পর্যবেক্ষকদের মতে, সকলের আস্থা বলতে মোদী মূলত সংখ্যালঘুদের কথা বলতে চেয়েছেন৷ গো-বলয়ের একাধিক রাজ্যে বিজেপির একচেটিয়া আধিপত্যের নেপথ্যে মুসলিমদের একাংশের সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ একইসঙ্গে এখানকার জাতপাতভিত্তিক ভোটব্যাঙ্কের হিসেব এই নির্বাচনে মেলেনি বলে বিজেপি এত সংখ্যক আসনে জিতেছে৷ কিন্তু গো-রক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কি সকলের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে? এবারের নির্বাচনের আরেক বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজের সব অংশের সমর্থন পেয়েছেন৷ তিনি বিভাজনকে অনুমোদন করেন না, বিজেপি করে না৷ গো-রক্ষকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই৷’’ একই বিজেপি নেতা, সাংবাদিক রন্তিদেব সেনগুপ্তের৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবার কাউকে বলেনি মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালাও৷ এ ধরনের ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে৷ এতে দলের ভাবমূর্তি মলিন হয় না৷ সেটার প্রমাণ নির্বাচনের ফল৷ অনেক জায়গায় দেখা গিয়েছে, কংগ্রেসের কর্মীরা গো-রক্ষার নামে এই কাজ করছে, লক্ষ্য বিজেপিকে বদনাম দেওয়া৷’’
বিরোধীদের বয়ানে বিজেপি সাম্প্রদায়িক দল৷ হিন্দুত্বের ভাবাবেগ জাগিয়ে তারা রাজনীতি করে৷ তাদের বক্তব্য, সরাসরি বিজেপির নির্দেশে না হলেও, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রমরমা গেরুয়া শিবিরের প্রচ্ছন্ন মদতে৷ মাথার উপর নরেন্দ্র মোদী থাকায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করার সাহস পায় তারা৷ বাম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গোমাতাকে নিয়ে বিজেপির প্রচার নাটক ছাড়া কিছু নয়৷ ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গোমাংস রপ্তানিকারক দেশ৷ যে সংস্থাগুলি মাংস রপ্তানি করে, তার মালিকরা হিন্দু৷ তাঁদের একজন ইন্দ্রা নুয়ি তামিল ব্রাহ্মণ এবং নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু৷’’ গো-রক্ষাকে প্রচারের আলোয় আনার উদ্দেশ্য কী? তন্ময়ের যুক্তি, ‘‘বিজেপির লক্ষ্য ভারতের দরিদ্র মুসলমানকে সমস্যায় ফেলা৷ গোমাংস এদের কাছে সুলভ প্রোটিনের উৎস৷ এর সঙ্গে ধর্মের রং মিশিয়ে দিলে একটা হিন্দু ভাবাবেগ তৈরি করা সম্ভব৷ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে এটা কাজে আসে৷ তাই উত্তরপ্রদেশে কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ রাজ্যে রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয় গোমাংস৷’’
অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারলেও নরেন্দ্র মোদীকে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়ের তকমা দেওয়া হয়৷ যদিও সব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনের ডাক দিয়ে দ্বিতীয়বার মসনদে বসেছেন তিনি৷ গো-রক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কি তিনি সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবেন?