জয়ী তারকাদের রাজনৈতিক কৌশল
৮ জুন ২০১৯লোকসভা নির্বাচনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তারকা প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা গিয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছিল। অতীত ও বর্তমানের বেশ কয়েকজন তারকাকে ভোটের ময়দানে নামিয়েছিল তৃণমূল ও বিজেপি। এঁদের মধ্যে বসিরহাট কেন্দ্রে নুসরত জাহান, যাদবপুর কেন্দ্রে মিমি চক্রবর্তী তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জিতেছেন। ফের জিতে সংসদে পৌঁছেছেন ঘাটাল কেন্দ্রের দেব, বীরভূমের শতাব্দী রায়। কিন্তু, আসানসোলে তৃণমূলের মুনমুন সেন পরাজিত হয়েছেন। বিজেপির লকেট চট্টোপাধ্যায় হুগলি আসনে জিতেছেন। কিন্তু, তাঁর দলের জয় বন্দ্যোপাধ্যায় উলুবেড়িয়া লোকসভা কেন্দ্রে হেরে গিয়েছেন।
বসিরহাটে বিপুল ভোটে জিতে চমকে দিয়েছেন নুসরত। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে মেরুকরণের হাওয়া টের পাওয়া যাচ্ছিল। তাতে আদতে লাভ হয়েছে বাংলা ছবির নায়িকার। তাঁর জয় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার ৩৬৯ ভোটে। যাদবপুরে লড়াইয়ে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বামেরাও। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা এখানকার ভোটাররা মিমিকে বেছে নিয়েছেন। সহজেই জিতেছেন তিনি। জয়ের ব্যবধান ১ লক্ষ ২৫ হাজার ২০৩। ব্যবধান কমলেও ১ লক্ষের বেশি ভোটে সহজ জয় পেয়েছেন বাংলা ছবির নায়ক দীপক অধিকারী ওরফে দেব। শতাব্দী টানা তিনবার জিতে সংসদে পৌঁছেছেন। হুগলিতে লকেটের জয় চমকপ্রদ। গতবার বিপুল ভোটে হারা আসনে তাঁর জয় ৭৩ হাজার ৩৬২ ভোটে। এই কেন্দ্রের অধীন সিঙ্গুর বিধানসভাতেও তৃণমূলকে পিছনে ফেলেছে বিজেপি। এই সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার সুবাদে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। অতীতের অভিনেতা জয় তারকা পরিচিতিকে ব্যবহার করলেও ভোটে সাফল্য পাননি।
প্রথমবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর মিমি-নুসরতকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রলের মুখে পড়তে হয়েছে। প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পরও একই ছবি দেখা গিয়েছিল। সমাজের একটি অংশের মতে, চলচ্চিত্রের তারকাদের কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দল কঠিন আসনে জয় নিশ্চিত করে। অভিনেতা-অভিনেত্রীর জনপ্রিয়তায় অন্য বিষয় ভেসে যায়। কিন্তু, সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের কোনো ভূমিকা থাকে না বললেই চলে। যদিও ভারতীয় রাজনীতিতে তারকাদের আগমন কোনো নতুন ব্যাপার নয়। অমিতাভ বচ্চন থেকে জয়াপ্রদা, শত্রুঘ্ন সিনহা থেকে জয়া বচ্চন, রেখা থেকে রাজবাব্বর কিংবা হাল আমলে দক্ষিণ ভারতের তারকা রজনীকান্ত ও কমল হাসানের নাম করা যায়। এঁদের কেউ এখনো সংসদ সদস্য, কেউ দলীয় সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। টলিউডের অভিনেতা বাদশা মৈত্র এই বিতর্কে বলেন, ‘যে কেউ যে কোনো পেশা থেকে রাজনীতিতে আসতে পারেন। তবে রাজনীতিতে এলে তার জন্য সময় দিতে হবে। আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। শুধু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে গেলেই চলবে না। তাঁকে যে জনতা ভোটে জিতিয়েছে, তাদের প্রতি দায়িত্বশীল থাকতে হবে।'
পশ্চিমবঙ্গে এবার যে তারকারা ভোটে লড়েছেন, তাঁরা সকলে একই পরিপ্রেক্ষিত থেকে রাজনীতিতে যোগ দেননি। নুসরত ও মিমির কাছে তৃণমূলের প্রস্তাব পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁরা সম্মত হয়েছেন। রাজনীতিতে আসা নিয়ে লকেট বললেন, ‘চলচ্চিত্রের জগৎ থেকে এই জায়গায় এসে পৌঁছব, সেটা আমারও জানা ছিল না। নিয়তি আমাকে এখানে টেনে এনেছে। কখন যে অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিতে চলে এসেছি, সেটা বুঝতে পারিনি। এটা একটা অসাধারণ জার্নি।' লকেটকে গত কয়েকবছর ধরে বিজেপির কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি হঠাৎ করে প্রার্থী হননি। একই কথা বলা যায় জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু, মিমি-নুসরতের মতো প্রার্থী হয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়ার মধ্যে অন্যায় কিছু দেখেন না তৃণমূল নেতা ব্রাত্য বসু। তাঁর মতে, ‘কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে এলে আপত্তি কিছু নেই। আমরাকরতে করতে শিখি। একজন রাজনীতিকের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।'
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, তারকাদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কৌশল থাকে। বসিরহাট ও যাদবপুর কেন্দ্র দুটিতে গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল জিতলেও এবার লড়াই কঠিন ছিল। সেখানে তৃণমূলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই নেতৃত্বকে চিন্তায় রেখেছিল। তাই ভিন্ন জগতের ব্যক্তিত্বকে ভোটের লড়াইয়ে নামিয়ে সেই বাধা অতিক্রম করতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ফলও মিলেছে হাতেনাতে। এখন দেখার এটাই, সংসদে কতদিন হাজির থাকতে পারবেন এই জনপ্রতিনিধিরা। অতীতে দেখা গিয়েছে, অনেক তারকা সংসদে হাজির থাকেন না তাঁদের পেশাগত ব্যস্ততার জন্য। তাঁরা বিতর্কে অংশ নেন না, কোনো প্রশ্ন করেন না। অথচ তাঁদের বেতন থেকে শুরু করে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভারতীয় করদাতাদের টাকায় মেটানো হয়। মিমি-নুসরতরা কতটা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তার দেখা যাবে ভবিষ্যতে।