পিকনিকের ক্রিকেট আর কতদূর?
১৬ মার্চ ২০১৭যে কোনো উপলক্ষ্য মানুষকে স্মৃতিকাতর করে তোলে৷ স্মৃতির অদৃশ্য গোঁফে তা দিতে দিতে আমরা পাতা ওল্টাই সময়ের অ্যালবামের৷ বাংলাদেশের শততম টেস্টের প্রান্তে এসে কেন জানি খুব করে মনে পড়ছে সেই সময়টা৷ ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর৷ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম৷ টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টস করতে নামলেন দুই বাঙালি অধিনায়ক! এক দিকে সৌরভ গাঙ্গুলি, ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে যেটি তাঁর প্রথম ম্যাচ, অন্য দিকে নাঈমুর রহমান; তাঁর তো বটেই, বাংলাদেশেরই সেটি প্রথম টেস্ট৷
মনে পড়ছে, অনেক আলোচনার জন্ম দিয়ে অভিষেক টেস্টের দলে ঢুকে পড়া হাবিবুল বাশারের সেই ঝলমলে ৭১ রানের ইনিংসটি৷ বেশি মনে পড়ছে আমিনুল ইসলামের ১৪৫৷ ৫৩৫ মিনিট উইকেটে ছিলেন আমিনুল, এখনো যেটি সময়ের হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘতম ইনিংস৷
প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয়ে গেল মাত্র ৯১ রানে৷ প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৯০ রানে ভারতে ৫ উইকেট ফেলে দিয়ে যে টেস্টে বাংলাদেশ অসম্ভব জয়ের এক কল্পনায় মেতে উঠেছিল, নিদেন ড্র-ও সম্ভব হবে বলে ভাবা হয়েছিল এক সময়; সেই ম্যাচটাই চার দিনে হেরে গেল!
এই সেদিন নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়েলিংটন টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৫৯৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করেও বাংলাদেশ ম্যাচ হেরেছিল৷ সেই ম্যাচেও বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের অনেক ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়৷ সত্যি বলতে কি, এমন ছায়া ফিরে আসে বারবার৷ শ্রীলঙ্কা সফরে গলের প্রথম টেস্টে পঞ্চম দিনেও ভর করেছিল সেই ভূত৷
কেন এমনটা হয় বারবার? কেন টেস্টে একটা বড় সময় দারুণ খেলেও এক সেশনেই সব প্রচষ্টো ধুলিসাতৎ করে দেয় বাংলাদেশ? এর উত্তর সেই অভিষেক টেস্টেই খুঁজে নেওয়া যায়৷ আমিনুলের পর আর কেউ ৫০০ মিনিট ব্যাটিং করার সাহস বা যোগ্যতা দেখাতে পারেননি৷ বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে ৪০০-র বেশি বল খেলা ইনিংসও মাত্র একটি, মোহাম্মদ আশরাফুলের৷ ৩০০-র বেশি বল খেলার ইনিংসও আছে মাত্র ছয়টি৷ অথচ টেস্ট ক্রিকেটে কখনো কখনো রান তোলার চেয়ে বল খেলতে পারাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সেই স্কিল বা দক্ষতা গড়ে ওঠেনি এখনো৷
অভিষেক টেস্টের জন্য একটা ‘থিম সং' বানিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)৷ যতদূর মনে পড়ে সেই গানটির শিরোনাম ছিল, ‘চার মারো রে, ছক্কা মারো রে৷' যেন চার-ছক্কা মারাই ক্রিকেটের একমাত্র নিয়ম৷ বাংলাদেশের দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট সেই ঘোর থেকে এখনো বেরোতে পারেনি৷
কেন পারেনি এর সহজ উত্তর আমাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট৷ যে ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা কখনো কখনো থার্ড ক্লাস মানের হয়৷ বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকেরা যেটিকে লেখেন 'পিকনিক ক্রিকেট'৷ সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাও ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটকে যেন পিকনিক হিসেবে নেন৷ খুব কম পত্রিকার সাংবাদিক হাজির থাকে মাঠে৷ পত্রিকার খুব সামান্য জায়গা বরাদ্দ পায়৷ বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকেরাও মাঠে গিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ দেখেন এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না৷ এই ম্যাচগুলোর কোনোটাই সম্প্রচার করা হয় না টিভিতে৷
সি.এল.আর. জেমস বহু আগে লিখে গেছেন, ‘‘যে শুধু ক্রিকেট জানে, সে ক্রিকেটের কী-ই বা জানে৷'' ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়; একটা সংস্কৃতি৷ বাংলাদেশের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের সূত্র ধরে সেই সংস্কৃতিটা তৈরি হতে পারত৷ কিন্তু সবাই এটিকে ধরে নিয়েছেন এক দিনের বনভোজন হিসেবে৷ ক্রিকেটাররা, অংশত দেশের মিডিয়া ও সমর্থকেরা; এবং অবশ্যই বিসিবি৷
বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটটা ঠিকমতো বোঝার আগেই নেমে পড়েছিল এই উত্তাল সাগরে৷ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয় ছিল দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য৷ অথচ এর তিন বছরের মাথায় টেস্ট অভিষেক৷ অথচ তখনো ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জয়ই ছিল সাকল্যে তিনটি৷ '৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই অবিস্মরণীয় জয় (বাকি দুটি জয় কেনিয়া ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে) আর এ দেশের মানুষের ক্রিকেটউন্মাদনা ছিল টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আসল চাবিকাঠি৷ তাতে অনুঘটক ছিল ক্রিকেট কূটনীতি৷
বাংলাদেশ টেস্ট খেলার মাত্র এক বছর আগে বড় পরিসরের ঘরোয়া ক্রিকেটের আয়োজন করেছে, যেটা তখনো ফার্স্ট ক্লাস স্বীকৃতিই পায়নি৷ কিন্তু গত ১৭ বছরে বাংলাদেশ তার ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটকে নিয়ে এখনো সিরিয়াস নয়৷ অথচ অপ্রস্তুত যাত্রাটা গুছিয়ে নিতে ১৭ বছর যথষ্টে দীর্ঘ সময় ছিল৷
আর এ কারণে যে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হতে পারত বাংলাদেশের ক্রিকেটের মূল মেরুদণ্ড, নতুন ক্রিকেটার তুলে আনার কারখানা; কার্যত সেটি ফলশূন্য৷ বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় দলের বেশির ভাগ তারকা আসলে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ফসল৷ সাকিব-মুশফিকরা ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র৷ হালের সৌম্য-মোস্তাফিজ-মিরাজরা বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের আবিষ্কার৷
এ ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখা প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটটিও ঢাকাকেন্দ্রিক ওয়ানডে টুর্নামেন্ট৷ যেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বেশির ভাগের আয়-রোজগারের বড় উৎস৷ ২০১২ সালে বিসিবি জাতীয় দলের বাইরে থাকা ১০০-র মতো ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারকে অবশ্য বেতনের আওতায় এনেছিল৷ কিন্তু তাদের মাসিক বেতন নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ১৮০ ডলার!
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটাকে শুরু থেকে জাতীয় লিগের আবহ দেওয়ার একটা চেষ্টা অবশ্য ছিল৷ দ্রুতই এই টুর্নামেন্ট অঞ্চলভিত্তিক দল দিয়ে তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের প্রশাসনিক বিভাগগুলো ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল নাম নিয়ে জাতীয় লিগে খেলে৷ এই জাতীয় লিগের পাশাপাশি খুব সম্প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল) নামের আরেকটি লিগ চালু করেছে বিসিবি৷ সেখানে চারটি দল খেলে৷
উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের এই দলগুলো বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির নামে থাকল কার্যত, তা নিয়ন্ত্রণ করে বিসিবি৷ জাতীয় লিগের বিভাগীয় দলগুলোও তা-ই৷ বিভাগ বা অঞ্চল পর্যায়ে কোনো ক্রিকেট অভিভাবক গড়ে ওঠেনি৷ যেমন, রাজশাহীর দলটা কী হবে, কীভাবে চলবে তা চালানোর কোনো কর্তৃত্ব রাজশাহীর নেই৷ ফলে এই দলগুলোর অঞ্চলভিত্তিক সমর্থনও গড়ে ওঠেনি৷ ফলে এই ক্রিকেটে কোনো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই৷ শিরোপা জয়ের মধ্যেও নেই তীব্র উত্সাহ বা উল্লাস৷
বাংলাদেশের ক্রিকেট ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, আরও বেশি করে ঢাকামুখী হয়েছে৷ প্রিমিয়ার লিগ আছে৷ পাশাপাশি আছে বিপিএল নামের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, যেটি ধীরে ধীরে হাওয়াও ফোলানো বেলুনের একটা বড় সাদা হাতি হিসেবেই প্রমাণিত হচ্ছে৷
ঢাকার বাইরে ক্রিকেট ছড়িয়ে দিতে না পারার কুফল কী হতে পারে এর বড় প্রমাণ চট্টগ্রাম৷ এক সময় চট্টগ্রামই ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতিভার উত্স৷ নান্নু-আকরাম খানদের সেই চট্টগ্রামে প্রতিভার স্রোতটি এখন ক্ষীণধারা৷
‘কানা মামাই ভালো' আপ্তবাক্যও সান্ত্বনা হয় না, যখন দেখবেন, ঘরোয়া এই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে খুব অসাধারণ খেলেও জাতীয় দলে জায়গা হয় না কারও৷ খুব সম্প্রতি তুষার ইমরান ঘরোয়া ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি রানের (১২৪৯) রেকর্ড ভেঙেছেন৷ জাতীয় লিগে টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি, বিসিএল-এ দুটি ডাবল সেঞ্চুরি৷ তবু তুষারের জায়গা হয় না টেস্ট দলে৷ কারণ, তুষারদের বলেই দেওয়া হয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেলা এ আর এমন কী! এখানে বোলারদের মান ভালো নয়; উইকেটের মানও৷
বিসিবির কর্তাব্যক্তিরাই যে মেনে নিয়েছেন, বাংলাদেশের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট আসলে পিকনিক ক্রিকেট!
ওয়ানডে ক্রিকেটে দলের সাফল্যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত বিসিবি৷ হয়ত আমরাও৷ কেন আমাদের আজও টেস্ট খেলার মানসিকতাই গড়ে উঠল না; এর উত্তর খোঁজা হবে কখন!
রাজীব হাসান, সংবাদকর্মী, প্রথম আলো
বন্ধু, রাজীবের এই ভাবনা আপনার কেমন লেগেছে? জানান আমাদের, লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷