পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির বিরোধ এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়
১৪ এপ্রিল ২০২৩এ জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বিরোধিতা এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেছেন কেউ কেউ৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ এবং ১৫টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে; আর ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলছে৷ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের হার গত কয়েক বছর ধরে একই রকম আছে৷
শান্তি চুক্তির একটি ধারায় বলা হয়েছে, .যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে উপজাতীয় জনগণের ভূমির মালিকানা চূড়ান্ত করেতাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হবে৷
এই ধারার বাস্তবায়ন চলমান আছে দাবি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, ভূমি জরিপ কাজ এখনো শুরু হয়নি৷ ভূমি কমিশন ভূমির বিবাদ নিষ্পত্তির পর জরিপের কাজ শুরু হবে৷ ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইনের গেজেট জারি করা হয়েছে৷ উক্ত আইনের বিধিমালা প্রণয়নের জন্য খসড়া বিধিমালা ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে৷ এই বিধিমালা প্রণয়নের কাজ ভূমি মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে৷
তবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (আইন) মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘‘আমি দুই বছর ধরে এই মন্ত্রণালয়ে কাজ করছি৷ এই সময়ের মধ্যে ওই বিধিমালার খসড়া আমার চোখে পড়েনি৷'' ভূমি মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই বিধিমালা চূড়ান্ত করার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই৷
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী, জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিতে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠনের কথা৷ এই কমিশনকে পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এযাবৎ যেসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে সেসব জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলের পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷ ভূমি কমিশন গঠন করে এই ধারার আংশিক বাস্তবায়ন করেছে সরকার৷
১৯৯৯ সালে খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়৷ এরপর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটিতে এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বান্দরবানে কমিশনের শাখা কার্যালয় খোলা হয়৷ ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কমিশনের শেষ সভা হয়েছে৷ করোনা মহামারি শুরুর পর এই কমিশনের কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে৷
সূত্র জানায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ২২ হাজার ৪৬৮টি আবেদন জমা পড়েছে৷ এরমধ্যে ৯ হাজার ৯৪১টি রাঙামাটির, ৭ হাজার ৯৭৫টি খাগড়াছড়ির এবং ৪ হাজার ৫৫২টি আবেদন বান্দরবান জেলা থেকে হয়েছে৷ আবেদন নিষ্পত্তি তো দূরে থাক এখনো সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে পারেনি কমিশন৷ ২০১৭ সাল থেকে কমিশনে নতুন আবেদন নেওয়াও বন্ধ আছে৷
এই কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে বলেন, কোন প্রক্রিয়ায় ভূমির বিরোধগুলো নিষ্পত্তি করা হবে সে বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনা নেই৷ এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের কথা থাকলেও মন্ত্রণালয় এখনো তা প্রণয়ন করেনি৷ এ ছাড়া কমিশনে জনবল সংকট রয়েছে৷ সব মিলিয়ে যতগুলো আবেদন কমিশনের হাতে রয়েছে তা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না৷ আগের আবেদন নিষ্পত্তি না করে নতুন আবেদন নেওয়া হবে না৷ ভূমির বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিধিমালা না হওয়ায় বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধারে অনেকে ভূমি কমিশনের আবেদন করেও আদালতে মামলা করেছেন৷
সংসদীয় কমিটিতে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে কথা হয় বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘চুক্তির সবকিছু একসঙ্গে বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ কারণ, চুক্তির একটা ক্যাপাবিলিটি তো আছে৷ আপনাকে আমি কোনো কিছু দেবো, আপনি নেবেন, আপনার নেয়ার মতো সক্ষমতাও তো থাকতে হবে৷ এসব নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়৷ এক হাতে তো সব কিছু বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তাই একটু সময় তো লাগবেই৷''
বাধা আমলাতন্ত্র
পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় আগে শান্তি চুক্তি হলেও এখনো ৩৩ শতাংশের বেশি ধারা বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল, সেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে সরকারের৷ যারা শান্তি চুক্তি সই করেছিল তারাই সম্ভবত এখন আর শান্তি চুক্তির বিষয়গুলো বিশ্বাস করেন না৷ বরং এর সামরিক সমাধানে বিশ্বাস করেন, যে কারণে শান্তি চুক্তির ধারাগুলো সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি৷''
‘‘যেসব ধারা এখানোবাস্তবায়িত হয়নি সেগুলো বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে৷ বিএনপি সরকারের সময় তো একেবারেই বন্ধ ছিল৷ আওয়ামী লীগ আমলে কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে৷ কিন্তু সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছে এবং তারা এখনও প্রবল৷ আর তারা প্রবল থাকার কারণেই সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকেও তারপরেও এ ধারাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না৷ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বাধা এখানে কাজ করছে৷ এই আমলাতন্ত্র বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে, আগে করেছে, এখনো করছে৷''