‘‘এই পাহাড়-পর্বতগুলিকে আমরা যেন কেবল আমাদের নিজ স্বার্থেই শাসন না করি, আমরা যেন কেবল এই পাহাড়-অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বার্থেই, তাহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের নিমিত্তই তাহাদের শাসনকার্য পরিচালনা করি। এই অঞ্চলে এরূপ শাসক চাই যিনি সরকারী শাসনচক্রের একটি অংশমাত্র হইবেন না, পার্বত্য অধিবাসীদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে তাহাকে যথেষ্ট সহনশীল হইতে হইবে, যে সহানুভূতির স্পর্শে বিশ্বের সকল মানুষকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব, তাহাকে সেই সহানুভূতি অনায়াসে ও দ্রুততার সহিত তাহাদের মধ্যে সঞ্চারিত করিতে হইবে। সেই শাসককে নতুন নতুন চিন্তাধারার উদ্ভাবন এবং সেই চিন্তাধারার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করিতে ও তাহা সফলভাবে প্রয়োগ করিতে হইবে। কিন্তু তাহাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কারে যাহাতে আঘাত না লাগে, তাহার জন্য সর্বদা সতর্ক থাকিতে হইবে।'' পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবন ও সরলতা দেখে কথাগুলো বলেছিলেন ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লিউইন (সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৭)।
এই তথ্য জানা জরুরি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলএবং সেখানের মানুষ বহু কাল থেকে তাদের ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও পরিচয়ের কারণে বিশেষ বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে এখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল ১৯০০ প্রযোজ্য। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও জাতিগত ভিন্নতার যথাযথ স্বীকৃতি নেই বলে পাহাড়ে বার বার সংঘাত হয়।
গত ৬ এপ্রিল পাহাড়ে আবার রক্তপাত হলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলেও এই রক্তপাত বন্ধ হয়নি। চুক্তিও যথাযথভাবে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এবার বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে যে আট জন নিহত হলেন, তারা বম জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। আমরা দেখলাম, ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী বম জনসংখ্যা মাত্র ১৩,১৯৩ জন। গত ১২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের তিন জন কো-চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, এলসা স্তামাপলো ও মীরনা কুনিংহাম কেইন যৌথ বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই আন্তর্জাতিক কমিশন তাদের বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফল হিসেবে এই ধরনের অস্থিরতা ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাকে দায়ী করেছেন। তারা সরকারের কাছে পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেছেন। যেমন, ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা; স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের লোকজনদের নিরাপত্তা বিধান করা এবং গত অক্টোবর মাসে যে সকল বম সদস্য পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করা এবং আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জরুরি সহায়তা প্রদান করা; আদিবাসী অধিকারকর্মীদের উপর ক্রিমিনালাইজিং বা ‘অপরাধীকরণ' কর্মকাণ্ড বন্ধ করা ও তাদের স্বাভাকিক জীবনযাপন নিশ্চিত করা; পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।
২.
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে বুকভরা আশা নিয়ে শান্তিচুক্তির দিনে, অর্থাৎ ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ উৎসবে মেতে উঠেছিলেন পাহাড়ের মানুষ। দুই দশকের বেশি সময়ের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান হয়েছিল তখন। এক নতুন জীবনের হাতছানি ওদের স্বপ্নের অনেক উচ্চে নিয়ে গিয়েছিল। শরণার্থী জীবন ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ দেশে ফিরে এসেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরষ্কার পেয়েছিলেন এবং প্যারিসে গিয়ে দলবলসহ পুরষ্কার গ্রহণ করেছিলেন। তখন শান্তিচুক্তি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির ছড়াছড়ি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কত অনুষ্ঠান দেখেছি তখন। মনে আছে এবং নিশ্চয় রেকর্ড আছে, টিভিতে দেখেছি, পাহাড়ের বুকে, হ্রদের জলের ধারে নাচছে একদল তরুণ-তরুণী, ওদের মনে কত আনন্দ। বাঙালি শিল্পী ও পাহাড়ি শিল্পী মিলে দ্বৈতকন্ঠের গানও অনেকবার প্রচারিত হয়েছে তখন টিভিতে।আজ শান্তিচুক্তির পঁচিশ বছর পর এইসব রক্তক্ষয়ী ঘটনায় এসব মনে পড়ছে আর মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হচ্ছে। কেন এখনও জুমের দেশে পাহাড়ি মানুষকে জীবনের অনিশ্চয়তা, দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা নিয়ে দিন কাটাতে হয়? কেন বম পরিবারগুলো চলে গেল ভারতে? আমরা দেখছি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এখন দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এটি এখন সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে বলেও মনে হয় না। দেশে মিডিয়াতে, নাগরিক সমাজের আলোচনায়, অন্য কোথাও শান্তিচুক্তি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখি না। শুধু মাঝে মাঝে এই ধরনের রক্তপাত ঘটলে বা বড় ধরনের মানবাধিকার লংঘিত হলে মিডিয়াতে কিছু খবর প্রকাশিত হয়।
আমরা সবাই জানি, চুক্তির পঁচিশ বছর পার হলেও মূল বিষয়গুলো এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন,পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের' সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ছিল, তা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের শাসনতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার কথা ছিল, হয়নি। পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমুহের নির্বাচন পঁচিশ বছরেও হয়নি। তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখনও জেলা পরিষদে পূর্ণাঙ্গরূপে হস্তান্তরিত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ অকার্যকর, ক্ষমতাহীন এবং এই পরিষদের বিধিমালাও তৈরি হয়নি। বাইরে থেকে এসে বড় বড় পর্যটন প্রকল্প চলে গেছে পাহাড়ে সাজেক পেরিয়ে, যেখানে পাহাড়ি অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। ভারত থেকে ফিরে আসা পাহাড়ি শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসনের কথা ছিল, হয়নি। ভূমি কমিশন দৃশ্যমান কাজ শুরুই করতে পারেনি। এই রকম অনেক ‘না হওয়ার' ভেতর দিয়ে যেতে যেতে অনেক উপসর্গ তৈরি হয়েছে পাহাড়ে, যার একটি মর্মান্তিক পরিণতি হলো আটজন বম সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা। এর আগেও অনেক রক্তপাত হয়েছে পাহাড়ে। সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, লংগদু পুড়ে গেছে, কোনোটারই সুষ্ঠু বিচার হয়নি।
৩.
অন্যদিকে আমরা দেখছি বিগত প্রায় ১২ বছরের বেশি সময় ধরে সরকার বলছে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের এই হিসাবটা খুব ইন্টারেস্টিং। এর আগে এভাবে আমরা কেউ হিসাব বা তালিকা করতে দেখিনি। ‘চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি' বাস্তবায়ন হয়েছে - এই হিসাব দেখলে যে কেউ বলবেন অগ্রগতি তো ভালোই। সরকারের এই হিসাবের চালাকি এখন দেখুন। যার কাছে পার্বত্য চুক্তির মূল কপি আছে তিনি একটু মিলিয়ে দেখবেন। যেমন, চুক্তির ‘গ' অনুচ্ছেদ দেখুন। এই অনুচ্ছেদের ধারা ১-এ বলা হয়েছে, একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হবে। ধারা ২ বলছে, এই পরিষদে একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। ধারা ৩-এ আছে, পরিষদে চেয়ারম্যানসহ ২২ জন সদস্য থাকবেন। ধারা ৪ বলছে, পরিষদে মহিলাদের জন্য ৩টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। ধারা ৫ হলো সদস্যদের যোগ্যতা নিয়ে। ধারা ৬ বলছে, পরিষদের মেয়াদ হবে ৫ বছর। ধারা ৭-এ আছে, পরিষদে সরকারের যুগ্ম-সচিবতুল্য একজন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন। ধারা ৮ হলো চেয়ারম্যানের পদ শূণ্য হলে করণীয় নিয়ে। ধারা ৯ হলো পরিষদের উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় নিয়ে। এখন যাদের কাছে চুক্তির কপি আছে, তারা সহজেই বুঝতে পারবেন এই ৯টি ধারা মিলে আসলে একটি মাত্র অনুচ্ছেদ। সরকার এখানে দেখাচ্ছে ৯টি ধারা পূর্ণ হয়েছে। এইভাবে হিসাব দেখিয়ে সরকার বলছে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। যেন ঐ কুমির ছানার গল্প। এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যাবে। তারপরও বলি, গত ১২ বছর ধরেই এই হিসাব চলছে, বাড়ছে না। আপনারা প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর সরকারের প্রকাশিত ক্রোড়পত্রগুলো মিলিয়ে দেখতে পারেন। আমি নিজে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস্ কাউন্সিলের ইউপিআর অধিবেশন চলার সময় দেখেছি সরকারের প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে এই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। ইউপিআর ৩টি অধিবেশনেই সদস্যরাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। ঐ বছর মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইউপিআর তৃতীয় অধিবেশনে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কসহ কয়েকটি দেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। সরকারও সুপারিশসমূহ গ্রহণও করেছে। বর্তমান সরকার টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। পাহাড়ের মানুষ মনে করছে, সরকার আর চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়, চুক্তি বাস্তবায়ন তাদের অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বহু আগেই হারিয়ে গেছে।
৪. পাহাড়ি জনগণের বহুদিনের দাবি, একটি সময়সূচিভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। আশা করবো, সরকার পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আরো বেশি আন্তরিক হবেন। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ১৮ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মানমর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হ।'
অনেক সময় বয়ে গেছে। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একটি সমাজ ও দেশ কতখানি উন্নত, সভ্য ও গণতান্ত্রিক, তার বিচার্য বিষয় হলো সেই দেশে ও সমাজে সংখ্যালঘু সমাজের মানুষ কেমন আছেন? আমরা আশা করবো, যে সৎ সাহস ও অঙ্গীকার নিয়ে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। আর এই ধরনের রক্তপাত বন্ধ হবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের বিশেষ দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। পাহাড়ের মানুষের প্রতি রাষ্ট্র যদি সৎ ও সংবেদনশীল হয়, নিশ্চয় সেখানে আস্থাহীনতার সংকট কেটে যাবে। মানুষের হাহাকার ও জীবনের অনিশ্চয়তা দূর হবে।