পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যার সমাধান আমরা কতটা চাই?
১৪ এপ্রিল ২০২৩আলাপটা শুরু করা যাক এক সিনেমার বরাত দিয়ে।
২০১৮ সালে নির্মিত ভারতীয় সিনেমা ‘আইয়ারি'র একটি দৃশ্যে কাশ্মীরে মোতায়েন মেজর তার ইউনিট চিফ কর্নেলকে বলেন, ‘‘আচ্ছা স্যার, এতসব জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন, সবাই মিলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করলেই তো পারে!''জবাবে কর্নেল তাকে বলেন, "কোনো সমস্যা থেকে যদি অনেকের ফায়দা হয়, তাহলে সেটা সমাধান করতে হয় না, জিইয়ে রাখতে হয়। কাশ্মীর কোনো একটি জায়গার নাম না, এটা পুরোদস্তুর এক ইন্ডাস্ট্রি। এখানে অনেক ধরনের ব্যবসা চলছে।”
এই কথোপকথনের এক পর্যায়ে তাদের গাড়িতে হামলা হয়। কর্নেলকে রক্ষা করতে গিয়ে মেজর গুলিবিদ্ধ হন, তবে প্রাণে বেঁচে যান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কাশ্মীর না।কাশ্মীরের বাস্তবতাও সেখানে নেই। তিনটি যুদ্ধের পর বিভক্ত হয়ে কাশ্মীর এখন ভারত, পাকিস্তান ও চীনের অংশ। ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সর্বদা তাদের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করে। তাই মাঝে মাঝেই সীমান্তে গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, পার্বত্য অঞ্চলের ভূ-সীমানা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দুই দশক সেখানে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত থাকলেও অস্ত্র ফেলে ১৯৯৭ সালে তারা সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি করে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও প্রতিশ্রুতি দেয় চুক্তি বাস্তবায়ন করে সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার।
কিন্তু শান্তির চুক্তির ২৬ বছর পরেও শান্তি ফেরেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে। হামলা,পাল্টা-হামলা, বন্দুক যুদ্ধ এবং খুনাখুনি যেন লেগেই আছে। সম্প্রতি এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়।কয়েকটি ঘটনা-যেমন, কুকি-চীনের আবির্ভাব, তাদের সাথে জঙ্গিদের আঁতাত, পর্যটকদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান এবং সর্বশেষ গত সপ্তাহে দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে আট ব্যক্তি নিহত হলে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এমন পরিস্থিতিতে দুই রকমের অভিযোগ শোনা যায়। একটি হচ্ছে, এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি নিয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলো একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। অন্যটি হলো, এসবের পেছনে সরকার বা প্রশাসনের মদত।
পেছনে তাকালে দেখা যায়, শান্তি চুক্তির পরপরই ইউপিডিএফ নামে নতুন এক সংগঠনের জন্ম হয়,যারা পরবর্তীতে শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএসের সাথেদ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেএসএস ভেঙে তৈরি হয় জেএসএস-এম এন লারমা দল। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে তৈরি হয় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দল। অনেকে মনে করেন, কোনো একটি উদ্দেশ্যে কুকি-চীনকে ব্যাপারটা সামনে আনা হয়েছে। জঙ্গিদের বিষয়টিও অনেকটা সেরকমই।
পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, এসব ভাঙন ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পেছনে প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। পক্ষান্তরে প্রশাসন দায়ী করে স্থানীয় উপদলীয় কোন্দলকে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশায় অনেকে অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বলেও শোনা যায়।
এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলায় কাজ করে অনেক এনজিও। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকে সেখানে গিয়ে বসবাস করছে। বর্তমানে সেটলার ও পাহাড়িদের অনুপাত প্রায় সমান। তাদেরও অধিকার ও স্বার্থের দাবি জোরালো হচ্ছে। এসবের মধ্যে পাহাড়ি গোষ্ঠী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
শান্তি চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারায় ভূমির মালিকানা, বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, চাদাবাজি এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে সেটলার, স্থানীয় প্রশাসন ও পাহাড়িদের মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। শান্তি চুক্তির সময় যে পরিস্থিতি ছিল, তা আর নেই। সেই সময় চুক্তি যত সহজে বাস্তবায়ন করা যেতো, এখন আর তা সম্ভব না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেন এমন প্রায় সকলের মতে, সেখানকার সমস্যাটা আসলে রাজনৈতিক, তাই তার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক উপায়ে। আর এজন্য দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কিন্তু সমস্যার সমাধান না হলে যদি অনেকের ফায়দা হয়, তাহলে সমস্যা হয়ত রয়েই যাবে। তাই পার্বত্য অঞ্চলে কারা কলকাঠি নাড়েন, কেন তা করেন, কী ধরনের ফায়দা পান--এসব নির্ণয় করেই পদক্ষেপ নিতে হবে, নতুবা কোনো কিছুই কাজে আসবে না।