পশ্চিমবঙ্গ এখন ধ্বংসস্তূপ
২১ মে ২০২০প্রবল শক্তিমান আমফান কার্যত শেষ করে দিলো দক্ষিণবঙ্গকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা এখনও প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। উত্তর ২৪ পরগনার বিরাট এলাকাও তাই। যেখানে যাওয়া যাচ্ছে বা খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে শুধুই ধ্বংসের ছবি। মেদিনীপুর বিপর্যস্ত। কলকাতা জলের তলায়। তিনশোর বেশি গাছ পড়ে গিয়ে রাস্তা অবরুদ্ধ। কলকাতার বড় অংশ বিদ্যুৎহীন। বিদ্যুতের তার জড়িয়ে, ট্রামের তার সঙ্গে নিয়ে গাছ পড়েছে অনেক জায়গায়। অনেক জায়গায় জল জমে প্রায় ডুবে গিয়েছে গাড়ি। জেলাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। বিদ্যুৎ নেই। কারণ, অধিকাংশ বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে ফেলেছে আমফান। শুইয়ে দিয়েছে সব মাটির বাড়ি। অস্থায়ী দোকান, এমনকী পাকা বাড়ির মাথার অ্যাসবেস্টাস বা টালির চাল সব ভেঙে গিয়েছে। হতাশ ও বিধ্বস্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় বুধবার রাতেই বলেছেন, ''আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। সব ধ্বংস করে দিয়েছে আমফান।''
তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ওপর ধ্বসংলীলা চালিয়ে আমফান এখন দুর্বল হয়েছে। ক্রমশ দুর্বল হতে হতে আমফান উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। তার প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলে বৃষ্টি হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্ভাবনা আর নেই।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি কতটা তার খবর এখনও পুরো আসেনি। কারণ, অধিকাংশ এলাকাই বিচ্ছিন্ন। ফোনেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী বুধবার রাতে বলেছিলেন, ''আমফান ধ্বংস করে দিয়েছে উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা আর সুন্দরবন। সমস্ত ব্রিজ ও বাঁধ ভেঙে গিয়েছে।'' ফলে ঠিক মতো যোগযোগ করাই সম্ভব হচ্ছে না। কবে ঠিক হবে, তা-ও বলা কঠিন। কচুবেড়িয়ার জেটি ভেঙে যাওয়ায় সাগর থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় জলপথে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে সকালেও সুন্দরবন, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এমনকী উত্তর ২৪ পরগনার বহু জায়গার কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ দিকে কলকাতা বিমানবন্দর সম্পূর্ণ জলমগ্ন। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ঐতিহাসিক যশোর রোড গাছ পড়ে কার্যত অবরুদ্ধ। কিছুটা দূর পরপর গাছ পড়ে গিয়েছে। ফলে সেই গাছ যতক্ষণ কেটে সরানো না হচ্ছে, ততক্ষণ রাস্তা চালু হবে না। কলকাতার অবস্থাও তাই। যেহেতু এর মধ্যে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে গিয়েছে, তাই সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। তাও কলকাতা বা আশপাশের এলাকার গাছ কেটে, রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে দু'এক দিনে। কিন্তু বাকি এলাকা? কবে সেখানে যোগাযোগ আবার স্বাভাবিক হবে তা বলা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সংযোগ শুরু হতেই দিন পনেরো লেগে যেতে পারে। এর মধ্যে কিছুটা স্বস্তির কথা হলো, যে ভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে আমফান, তার তুলনায় মৃত্যু কম হয়েছে। কারণ, সতর্কতা মেনে সকলে বাড়ির ভিতরে ছিলেন। প্রচুর লোককে আগেই আশ্রয়স্থলে নিয়ে গিয়েছিলো সরকার। তবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অবস্থা সামনে এলে বোঝা যাবে কতজন মারা গেলেন। এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ১৪ জন।
সব চেয়ে ক্ষতি হয়েছে সাধারণ লোকের এবং সরকারি পরিকাঠামোর। সুন্দরবনে অসংখ্য বাঁধ ভেঙেছে। ফলে নোনা জল ঢুকে পড়েছে চাষের জমিতে। মাটির বাড়ি সব মিশে গিয়েছে। মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় হাজার হাজার গাছ পড়ে গিয়েছে। কত যে বাড়ি ভেঙেছে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে রাস্তা ধুয়ে গিয়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি শুয়ে পড়েছে। পানীয় জল সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। এত মানুষের ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয় আছে। একেই অর্থনীতি চাপে ছিলো। তার ওপর করোনার চাপ যুক্ত হয়েছিলো। কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্যকে অবিলম্বে তার প্রাপ্য ৬১ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হোক। না হলে খুবই অসুবিধা হচ্ছে।
আমফান তো হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেলো। রাজ্যকে আরও কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়ে গেলো। ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের পরিকাঠামো তৈরির জন্য জোর দিয়েছিলেন। রাস্তা ভালো হয়েছিলো। নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছিলো। জলপথ উন্নয়নে কাজ হয়েছিলো। দক্ষিণবঙ্গে পরিকাঠামোয় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কবে আবার আগের অবস্থায় আনা যাবে, তা বলা যাচ্ছে না। আর সুন্দরবনে চাষের জমি ফের চাষযোগ্য হবে অন্তত বছর তিন চার পরে। নোনা না কাটলে কোনও ফসল হবে না। সে জন্যই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে গেলো।
জিএসটি বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন আধিকারিক সুমিত দত্ত মজুমদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে আমফানের তাণ্ডবকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করলেই প্রচুর কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্য পাওয়া যাবে। জিএসটি আইনেও সেস বসানোর ব্যবস্থা আছে। সেটা হওয়া উচিত। আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গে যা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে জাতীয় বিপর্যয়।''
একে করোনা, তার ওপর আমফান সত্যিই শেষ করে দিলো পশ্চিমবঙ্গকে।
তবে জীবন তো থেমে থাকে না। তাই সাধারণ মানুষ আবার উদ্যোগী হয়ে তাঁদের দোকান, বাড়ি সোজা করার চেষ্টা করছেন। মেদিনীপুরের অনেক জায়গায় তাঁরা আবার দোকান বা বাড়ির চাল প্লাস্টিকের শিট দিয়ে ঢাকছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে, যেখানে ক্ষতি কম হয়েছে। সেখানে অন্তত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু আসল উপদ্রুত এলাকায় জীবনযুদ্ধ অনেক কঠিন হয়ে গেলো লাখ লাখ লোকের।
জিএইচ/এসজি(এএনআই, পিটিআই)