পশ্চিমবঙ্গে যৌন নিগ্রহের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪একটি ঘটনা সামান্য কিছুদিন আগের, কিন্তু এখনও সেই কলঙ্কের রেশ রয়ে গেছে৷ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীতে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আসা এক ছাত্রীকে সিনিয়র তিন ছাত্রের যৌন নিগ্রহ, ব্ল্যাকমেল করা, তার থেকে জোর করে টাকা নেওয়ার সেই ঘটনা সারা পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, ভারতে এবং গোটা বিশ্বে বিশ্বভারতীর যত ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তাঁদের সবাইকে লজ্জিত করেছিল৷ সোশ্যাল মিডিয়া সরব হয়েছিল সমবেত সমালোচনা আর প্রতিবাদে৷
তবে বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রীর শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার থেকেও বেশি লজ্জাজনক হয়ে উঠল, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যেভাবে এই কলঙ্ক চাপা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল! এক্ষেত্রে মূল অভিযুক্ত দুজন৷ কলাভবনের অধ্যক্ষ এবং বিশ্বভারতীর উপাচার্য৷ এঁদের দুজনের অমানবিকতা সম্ভবত শিক্ষাক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়ানোর অপচেষ্টার নজির হয়ে থাকবে! তিন সহপাঠীর হাতে মেয়েটির অসম্মানের যেটুকু বাকি ছিল, সেটাও পুরো করে দিলেন ওই দুই প্রশাসনিক কর্তা – মেয়েটিকে পুলিশে অভিযোগ দায়ের না করার পরামর্শ দিয়ে এবং নতুন জামা-কাপড় ইত্যাদি কেনার খরচ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে!
বিশ্বভারতীর মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কলঙ্কের দাগ ফিকে হওয়ার আগেই ঘটে গেল দ্বিতীয় ঘটনা৷ এবার খাস কলকাতা শহরে, আরেক সম্মানিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সেখানে বাৎসরিক উৎসব চলছিল৷ তারই মধ্যে একদল ছাত্র একজন ছাত্রীকে জোর করে নিজেদের হোস্টেলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ৷ সেখানে ওই মেয়েটিকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ৷
যদিও সেই রাতে আসলে ঠিক কী ঘটেছিল, সেই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্যে ফারাক রয়েছে৷ কিন্তু যেটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই, তা হল নিগৃহীত ওই ছাত্রী এবং তার বাবা অভিযোগ জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গেলে, যে চরম অসভ্যতা তাদের সঙ্গে করা হয়েছে, সেই নিয়ে৷
অভিযোগ, মেয়েটি তাঁর বাবাকে নিয়ে উপাচার্যের দপ্তরে গেলে প্রথমে তাদের দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়৷ তারপর বলা হয়, দুদিন পরে আসতে! ঠিক কেন দুদিন, কেন দু সপ্তাহ বা দুমাস কিংবা দুবছর নয়, তা যদিও জানা যায়নি৷ তবে বহু পুরনো একটি আপ্তবাক্য ফের প্রমাণ হতে চলেছে যে, জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনায়েড! যদিও মেয়েটির বাবা হাল ছাড়বেন না৷ তিনি বলেছেন, তিনি ন্যায়বিচার চান৷ ঠিক যে কথা বলে যন্ত্রণা এবং চোখের জল চেপে রেখে মেয়েকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলেন সিকিম থেকে আসা এক অসহায় বাবা, যিনি রবীন্দ্রনাথের আদর্শে আদরের কন্যাকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন৷
দুটি ঘটনাতেই শেষ পর্যন্ত পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রবল অনাগ্রহ সত্ত্বেও৷ শান্তিনিকেতনের ঘটনাটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা গোটা বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছে৷ কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ঠেকাতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশিত যে বিশাখা নির্দেশমালা আছে, সেই অনুযায়ী অভিযোগের বিচার হচ্ছে এবং সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক এবং প্রাক্তনীরাও প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন৷
কিন্তু এই সবকিছু ছাপিয়ে উঠে আসছে একটিই প্রশ্ন৷ যে উপাচার্য, যে প্রশাসন নির্বিকার রইল ছাত্রীদের এই নিগ্রহের কথা জেনেও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই কলঙ্কের কথা যারা কার্যত ধামাচাপা দিতে চাইল, তার কী শাস্তিবিধান হবে! ঘটনা পরম্পরাতেই স্পষ্ট যে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই নিজেদের দায়িত্ব, নিজেদের কর্তব্য অস্বীকার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে অপরাধকে পরোক্ষে প্রশ্রয় দিয়েছে৷ এবং এখানেই উঠে আসছে পরের প্রশ্ন৷ সাধারণত রাজনীতিকদের মধ্যে যে গাফিলতি, কর্তব্যে অনীহা, যে দায়িত্ব এড়ানোর স্বার্থপর মানসিকতা দেখা যায়, সেই নৈরাজ্য এবার তাদের মধ্যেও কায়েম হবে, যাদের হাতে আমরা ছেড়ে রাখছি আমাদের ভবিষ্যৎ? কী শিক্ষা তাঁরা দিয়ে যাবেন আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে?