1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নীল ঢেউ থামিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ‘হেক্সা'

রাহেনুর ইসলাম
১৯ নভেম্বর ২০২৩

‘‘মহা-ভারত'' হলো না। ভারতের শাসন থামিয়ে ভারতেরই মাটিতে ‘হেক্সা' (ষষ্ঠ শিরোপা) উৎসবে মাতল অস্ট্রেলিয়া।

https://p.dw.com/p/4Z9PC
ভারতেরই মাটিতে ‘হেক্সা' (ষষ্ঠ শিরোপা) উৎসবে মাতল অস্ট্রেলিয়া
ভারতেরই মাটিতে ‘হেক্সা' (ষষ্ঠ শিরোপা) উৎসবে মাতল অস্ট্রেলিয়াছবি: SAJJAD HUSSAIN/AFP

ভারতকে ছয় উইকেটে হারিয়ে প্যাট কামিন্সের দল জিতল ষষ্ঠ ওয়ানডে বিশ্বকাপ।

 ভারতের ২৪০ রানের চ্যালেঞ্জ ট্রাভিস হেডের সেঞ্চুরিতে ৪২ বল বাকি থাকতে পেরিয়ে উৎসবে মাতেন ওয়ার্নার, স্মিথ, স্টার্করা। আহমেদাবাদের নীল সমুদ্রে হেডই আসলে তুলেছেন হলুদ ঢেউ।

২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে রিকি পন্টিংয়ের ১৪০* রানের ইনিংসে স্বপ্ন ভেঙেছিল ভারতের। আজ ম্যাচ সেরা হেডের ১২০ বলে ১৫ বাউন্ডারি ৪ ছক্কায় ১৩৭ রানের ইনিংসটা দুই দশক আগের চেয়েও বেশি পুড়িয়েছে রোহিত শর্মার দলকে। কারণ ইনিংসটা জোহানেসবার্গে সাত সাগর পাড়ে নয়, হেড খেলেছেন সবরমতীর তীরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।

হেডের প্রতিটা শট বুকে শেল হয়েই বিঁধেছে স্বাগতিক ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শকের। ম্যাচ শেষ না হতে তাই খালি হতে থাকে স্টেডিয়াম।

 বিশ্বকাপ ফাইনালে রান তাড়ায় হেডের ইনিংসটিই সবচেয়ে বড় স্কোর। আগের সেরা ১৯৯৬ সালে অরবিন্দ ডি সিলভার ১০৭*।

অথচ শিরোপা উৎসব করতে জাঁকজমক আলোর খেলা, বিমান প্রদর্শনী কোন আয়োজনের কমতি রাখেনি আয়োজকরা। কিন্তু মহোৎসবের সেই মঞ্চটা মনে হচ্ছিল মরা বাড়ি। ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শকের গর্জন স্তব্ধ করে শিরোপা উৎসবে মাতে অস্ট্রেলিয়া।

বিরাট কোহলি হয়ত আগেই বুঝতে পেরেছিলেন নিয়তিটা। আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে ভেঙে পড়েছিলেন হতাশায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ‘‘কাঁদছিলেন কোহলি''।

 এত ভালো শুরু করেও ২৪০ রানে অলআউট হওয়াটা মানতে পরাছিলেন না কোহলি। যে দলটা গোটা বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে, তারাই কিনা প্রথমবার অলআউট হলো ফাইনালের মত মঞ্চে।

কোহলি জানতেন এতঅল্প রানের পুঁজিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো কঠিন। টানা ৮ ম্যাচ জিতে ফাইনালে পৌঁছানো অস্ট্রেলিয়া পেয়ে গিয়েছিল শিরোপার গন্ধ। তাদের আগ্রাসন দেখে ধারাভাষ্যকররা পর্যন্ত বলছিলেন,‘‘অস্ট্রেলিয়া কি ২০ ফিল্ডার নিয়ে খেলছে।''

 ব্যাটিংয়ে অবশ্য ২০ জনের দরকার নেই। একাই ভারতের স্বপ্ন সবরমতীর তীরে ভাসিয়ে দিলেন ট্রাভিস হেড। বিশ্বকাপ ফাইনালে বিপর্যয়ের মুখে সেঞ্চুরি করেও উচ্ছ্বাসে ভেসে যাননি এই ওপেনার। শুধু ব্যাট উঁচিয়ে তুলে ধরেছিলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। জানতেন কাজটা বাকি আছে এখনও।

ম্যাচ শেষে উচ্ছ্বাসে ভাসেন অজি তারকারা
ম্যাচ শেষে উচ্ছ্বাসে ভাসেন অজি তারকারাছবি: SAJJAD HUSSAIN/AFP

সেটাই করলেন মার্নাস লাবুশানেকে সঙ্গে নিয়ে। ২০১৫ সালের পর অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিলেন আরও একটি বিশ্বকাপ। ২০০৩ সালে জোহানেসবার্গের ফাইনাল হারের প্রতিশোধ নেওয়ার ভারতের স্বপ্নটা তিনিই পরিণত করলেন দুঃস্বপ্নে। ২০১১'র পর তাই আর কোনো ফরম্যাটের বিশ্বকাপ জেতা হলো না ভারতের।

২৪০ রানের পুঁজি বলেই মোহাম্মদ সামির হাতে প্রথমবার দ্বিতীয় ওভার তুলে দেন রোহিত শর্মা। আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেনে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে সফল বোলারটি। নিজের দ্বিতীয় বলেই স্লিপে বিরাট কোহলির ক্যাচ বানিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারকে ফেরান সামি। গর্জে উঠে পুরো স্টেডিয়াম।

মিচেল মার্শ ভালো শুরু করলেও থামেন ১৫ রানে। যশপ্রীত বুমরাহর বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তিনি। এরপর ৪ করা স্টিভেন স্মিথকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারানোটা ছিল আরও বড় ধাক্কা।

বুমরাহর স্লোয়ার স্মিথের প্যাডে আঘাত লাগলে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। ট্রাভিস হেডের সঙ্গে আলোচনা করে রিভিউ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্মিথ। অথচ বলের ইমপ্যাক্ট ছিল অফস্টাম্পের বাইরে। রিভিউ নিলে আউট হতেন না স্মিথ।

বুমরাহর স্লোয়ার স্মিথের প্যাডে আঘাত লাগলে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার
বুমরাহর স্লোয়ার স্মিথের প্যাডে আঘাত লাগলে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ারছবি: ANDREW BOYERS/REUTERS

নিজের ভুলটা বুঝেই হয়ত প্রায়শ্চিত্ত করার পণ করেন হেড। চতুর্থ উইকেটে মার্নাস লাবুশানের সঙ্গে গড়েন ১৯২ রানের জুটি। এই জুটিটাই ঘুরিয়ে দেয় ম্যাচের গতিপথ। হেডের পাশে লাবুশানের ১১০ বলে অপরাজিত ৫৮ রানের ইনিংসটি মহাকাব্যিক না হলেও মহাগুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে। অথচ শুরুতে বিশ্বকাপের দলেই ছিলেন না লাবুশানে!

অস্ট্রেলিয়ার জয়টা নিশ্চিত হয় গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বাউন্ডারি লাইনে মোহাম্মদ সিরাজের বল পাঠিয়ে দুই রান নিলে। লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামিন্স, ওয়ার্নাররা ছুটে আসেন মাঠে। মাতেন বাঁধনহারা উল্লাসে। এমন উদযাপন তো অস্ট্রেলিয়াকেই মানায়।

আহমেদাবাদের নীল সমুদ্রে হেডই আসলে তুলেছেন হলুদ ঢেউ
আহমেদাবাদের নীল সমুদ্রে হেডই আসলে তুলেছেন হলুদ ঢেউছবি: Mahesh Kumar A./AP/picture alliance

ফাইনাল শুরুর অনেক আগেই উৎসবের নগরী হয়ে উঠেছিল আহমেদাবাদ। এমন ঢেউয়ে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম রীতিমত নীল সমুদ্র। ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়িও। অথচ সেই ফাঁক গলে ১৪তম ওভারে এক দর্শক ঢুকে পড়লেন মাঠে!

শুরুতে ব্যাট করতে নেমে টানা ৯৭ বল ভারতের বাউন্ডারি মারতে না পারা! যে দলটা প্রথম ১০ ম্যাচ জিতেছে প্রতিপক্ষকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে তারাই ফাইনালে ভুগেছে স্নায়ুর চাপে। শিরোপা স্বপ্নে বিভোর এক লাখ ৩২ হাজার দর্শকের সামনে শেষ পর্যন্ত ২৪০ রানে অলআউট স্বাগতিকরা। মিচেল স্টার্ক নেন ৩ উইকেট। 

প্রথম ১০ ওভারে ভারতের রান ছিল ৮০। শেষ ১০ ওভারে ৪৩! পুরো  ইনিংসটাই এমন দুইভাবে বিভক্ত ভারতের। উড়ন্ত শুরুর পর মাঝখানে কোহলি-লোকেশ রাহুল জুটি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আহমেদাবাদের ধীরগতির উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের গতি, কাটার,স্লোয়ার, বাউন্সারে স্কোরটা বড় করতে পারেনি তারা। 

ভারতের শুরুটা হয়েছিল উড়ন্ত। ৯.৩ ওভারে ১ উইকেটে স্কোর ৭৬। রোহিত শর্মা তখন শাসন করছেন অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের। ফাইনালের আগে স্টুয়ার্ট ব্রডের ‘ভারত হচ্ছে ফুটবলের ব্রাজিল' কথাটা তখন আলোচনা হচ্ছিল ধারাভাষ্যকক্ষে। 

কিন্তু প্রতিপক্ষের নাম যে অস্ট্রেলিয়া। নকআউটের প্রবল চাপের ম্যাচে সেরাটা খেলে তারা। এর আগে সাতবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলে পাঁচবারই জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩ সালে ভারতকেই জোহানেসবার্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ১২৫ রানে। রিকি পন্টিংয়ের ১৩২ রানের অতিমানবিক ইনিংসে স্রেফ উড়ে গিয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির দল।

 আজ তাই ভারতের জন্য ছিল প্রতিশোধের মিশন। তবে আহমেদাবাদ স্টেডিয়াম নীল সমুদ্র হয়ে গেলেও তাতে ডুবে যায়নি পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। বরং পাল্টা আঘাতে ম্যাচে ফিরেছে দুর্দান্তভাবে। 

পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওপর চড়াও হয়ে দ্বিতীয় বলে ছক্কা আরা তৃতীয় বলে বাউন্ডারি মারেন রোহিত। পরের বলটা ক্রিজ ছেড়ে বেড়িয়ে ছক্কা মারতে যেয়ে আকাশে তুলে দেন রোহিত (৩১ বলে ৪৭)।

 কাভার থেকে ছুটে এসে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন ট্রাভিস হেড। এই ক্যাচই মোড় ঘুড়িয়ে দেয় ফাইনালের। কমে যায় ভারতের রানের গতি। ৪ রান করে প্যাট কামিন্সের বলে শ্রেয়াস আয়ার ফিরে গেলে চাপটা বাড়ে আরও। টানা দুই সেঞ্চুরি করা আয়ার ব্যর্থ আসল মঞ্চেই। এই বিশ্বকাপে প্রথম ১০ ওভারে তিনবার ব্যাটিংয়ে নেমে ০, ৪ ও ৪ রানে আউট হয়েছেন তিনি। 

গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই দ্রুত উইকেট হারানোর পর হাল ধরেছিলেন বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। আজ ফাইনালেও দুজন চতুর্থ উইকেটে গড়েন ৬৭ রানের জুটি। তবে ধীর গতিতে খেলায় ১১ থেকে ২০ ওভারে ৩৫ আর ২১ থেকে ৩০ ওভারে কেবল ৩৭ রান যোগ হয় স্কোরে। পরপর দুই উইকেট হারিয়ে টানা ৯৭ বল ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারি মারেননি অতি সতর্কতায়।

৯৭ বল পর ২৭তম ওভারে প্রথম বাউন্ডারি পায় ভারত।ম্যাক্সওয়েলকে স্কুপ করে বাউন্ডারিতে পাঠান রাহুল। কোহলি ফিফটি করেন ৫৬তম বলে। তাতে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসাবে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের পর ফাইনালে ফিফটি করলেন এই কিংবদন্তি। আগের ছয়জন মাইক ব্রেয়ারলি (১৯৭৯), ডেভিড বুন (১৯৮৭), জাভেদ মিয়াঁদাদ (১৯৯২), অরবিন্দ ডি সিলভা (১৯৯৬), গ্র্যান্ট এলিয়ট (২০১৫) ও স্টিভেন স্মিথ।

ফিফটির কিছুক্ষণ পরই পুরো স্টেডিয়াম স্তব্ধ করে দিয়ে কোহলি বোল্ড হয়ে যান ৬৩ বলে ৫৪ করে। প্যাট কামিন্সের শর্ট বলটা ব্যাটের কানায় লেগে আঘাত হানে স্টাম্পে। ডাগআউটে তখন মাথায় হাত অশ্বিনের। চুপসে যায় পুরো গ্যালারি। 

অধিনায়ক রোহিত শর্মার আরো একটু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল, বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞই
অধিনায়ক রোহিত শর্মার আরো একটু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল, বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞইছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS

সূর্যকুমার যাদবের আগে পাঠানো হয় রবীন্দ্র জাদেজাকে। তবে শুরু থেকে অস্বস্বিতে থাকা জাদেজা ২২ বলে ফেরেন ৯ করে। ৮৬ বলে ফিফটি করা রাহুল মনযোগ দিয়েছিলেন ইনিংস গড়ায়। মিচেল স্টার্কের স্বপ্নের এক বলে ৬৬ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। সিমে পড়ে মুভমেন্ট করেছিল বলটা, যার ক্রিকেটীয় নাম ‘স্ক্র্যাম্বলড সিম'।

৪০ ওভার শেষে ভারতের স্কোর ৫ উইকেটে ১৯৭। সেখান থেকে ২৮০-২৯০ রানের পুঁজি পাওয়াটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে সম্ভব হয়নি সেটা।

অজ নিশ্চিতভাবে হার্দিক পাণ্ডের অভাববোধ করছিল ভারত। এই অলরাউন্ডার না থাকায় নষ্ট হওয়া ভারসাম্যটা বাজেভাবে ফুটে উঠল ফাইনালের মঞ্চে। টেলএন্ডারদের ব্যর্থতায় ভারত থামে ২৪০ রানে।

গ্লাভস হাতে অনন্য রেকর্ড গড়েছেন অস্ট্রেলিয়ার জশ ইংলিশ। প্রথম উইকেটরক্ষক হিসাবে বিশ্বকাপ ফাইনালে আজ ৫টি ক্যাচ নিয়েছেন তিনি। আগের ১২ আসরে ফাইনালে তিনজনের যৌথ সর্বোচ্চ ক্যাচ ছিল ৩টি করে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ভারত ৫০ ওভারে ২৪০/১০ (রাহুল ৬৬, কোহলি ৫৪, রোহিত ৪৭ ; স্টার্ক ৩/৫৫, কামিন্স ২/৩৪)

 

অস্ট্রেলিয়া ৪৩ ওভারে ২৪১/৪ (হেড ১৩৭, লঅবুশানে ৫৮*, মার্শ ১৫ ; বুমরাহ ২/৪৩, সামি ১/৪৭)

ফল  : অস্ট্রেলিয়া ৬ উইকেটে জয়ী

ম্যাচ সেরা : ট্রাভিস হেড

সর্বোচ্চ রান : বিরাট কোহলি (৭৬৫)

সর্বোচ্চ উইকেট : মোহাম্মদ সামি (২৪)

রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক