1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
খেলাধুলাসাউথ আফ্রিকা

আবার সাউথ আফ্রিকার হৃদয় ভেঙে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া

অম্লান মোসতাকিম হোসেন
১৬ নভেম্বর ২০২৩

বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইডেন গার্ডেনে শুরুতে ব্যাট করতে নেমে ডেভিড মিলারের সেঞ্চুরিতে ২১২ রান তুলতে পেরেছিল সাউথ আফ্রিকা৷ জবাবে ৭ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়া৷

https://p.dw.com/p/4YvKu
কামিন্স আর স্টার্ক জয়ে আলিঙ্গনের মুহূর্তে
স্নায়ুচাপ সামলে অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত করার পর কামিন্স আর স্টার্কছবি: Andrew Boyers/REUTERS

আট বছর পর আবার উঠেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে৷ সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ভারত৷

বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচ, বৃষ্টি, অস্ট্রেলিয়া-সাউথ আফ্রিকাকে এক ম্যাচই মনে করাল অনেক হাহাকারের গল্প৷ একটা বিশ্বকাপের ফাইনাল তাদের কাছে দীর্ঘ আক্ষেপের নাম, নন্দন কাননে সেই আশার স্বপ্নটা বুনতে না বুনতেই তো ছিঁড়ে গেল৷ ‘চোকার' অপবাদটা কি আরও স্থায়ীভাবে তাদের নামের সাথে সেঁটে গেল? 

ইতিহাস অবশ্য বলে, অস্ট্রেলিয়া আর সেমিফাইনাল সাউথ আফ্রিকার সামনে এলে নাটক না হয়ে যায় না৷ আজকের ম্যাচের স্কোরলাইন তো ২৪ বছর আগের সেই থ্রিলারকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল৷ ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া শুরুতে ব্যাট করে ২১৩ করেছিল৷ আজ তাদের সেই রান তাড়া করে জিততে হলো অনেক স্নায়ুচাপ সামলে৷ ২৪ বছর আগে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচে টাই হয়েও ফাইনালে ওঠা হয়নি সাউথ আফ্রিকার৷ আজকের ম্যাচটা হয়তো সেই সেমির মতো রোমাঞ্চকর হয়নি, তবে প্রোটিয়ারা ভুলে যেতে চাইবে দুইটি ম্যাচই৷ 

সাউথ আফ্রিকার পেসার কোটজিয়া ম্যাচ শেষে
ম্যাচ শেষে হতাশাগ্রস্ত সাউথ আফ্রিকার পেসার কোটজিয়াছবি: Andrew Boyers/REUTERS

অস্ট্রেলিয়ার জন্য ব্যাপারটা অবশ্য তা নয়৷ ২৪ বছর আগে সেমিতে তারা প্রায় খাদের কিনারায় গিয়েও বিশ্বকাপ জিতেছিল৷ বিশ্বকাপ ইতিহাসেই তারা সেমিফাইনালে হেরেছে মাত্র একবার৷ ২০১৯ সেমির ব্যতিক্রম বাদ দিলে আজকের ম্যাচের পর মোটামুটি বলে দেওয়া যায়, সেমিতে অস্ট্রেলিয়া হারে না৷ বিশেষ করে সাউথ আফ্রিকার সাথে তো নয়ই৷ ১৯৯৯ সালের ম্যাচটা তো আছেই, ২০০৭ বিশ্বকাপেও তো অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারতে হয়েছিল আফ্রিকার দলটিকে৷ অথচ ওয়ানডেতে দুই দলের গত ১৮ বারের ১৫ বারের দেখাতেই জিতেছে সাউথ আফ্রিকা, বিশ্বকাপের আগেই তো তারা হারিয়েছে অজিদের৷ এমনকি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেও জিতেছিল হেসেখেলে৷ কিন্তু মঞ্চটা যখন সেমিফাইনাল, তখন ইতিহাস আসে ফিরে ফিরে!

আর সাউথ আফ্রিকার সেমি মানেই সুযোগ নষ্টের আক্ষেপ আর ট্র্যাজেডির নায়ক- এই দুইটি অধ্যায় তো থাকতেই হবে৷ আজকের ম্যাচে সুযোগ কাজে না লাগানোর এত দৃষ্টান্ত আছে, সেগুলো নিয়ে আলাদা আরেকটা গল্পই  লিখে ফেলা যায়৷ এক ট্রাভিস হেডের ক্যাচ সাউথ আফ্রিকা ছেড়েছে দুইবার৷ প্রথমবার ৪০ রানে জেরাল্ড কোটজিয়ার বলে হেনড্রিক্স নিতে নিতেও পারেননি, এরপর ৫৭ রানে আরেকবার ক্লাসেন জমাতে পারেননি হাতে৷ শেষ পর্যন্ত ৬০ রানে হেড আউট হয়ে যাওয়ায় আফসোস বেশিক্ষণ করতে হয়নি, কিন্তু এমন ম্যাচে তো এসবই ব্যবধান হতে পারত৷ 

আক্ষেপ হতে পারে স্টিভ স্মিথের ক্যাচের জন্যও৷ ১০ রানে কুইন্টন ডি কক কঠিন ক্যাচটি নিতে পারেননি৷ শেষ পর্যন্ত ৩০ রানে যখন থেমেছেন স্মিথ, অস্ট্রেলিয়ার জাহাজের সামনে স্পষ্ট জয়ের দিগন্তরেখা৷ এমনকি জয় থেকে যখন ৯ রান দূরত্বে অস্ট্রেলিয়া, হাতে মাত্র তিন উইকেট৷ তখনও মার্করামের বলে কামিন্সের কঠিন ক্যাচটা ধরতে পারলেন না সেই ডি ককই৷ দিনটাই যে আসলে সাউথ আফ্রিকার ছিল না!

কিন্তু সাউথ আফ্রিকা সম্ভবত বেশি আফসোস করবে অধিনায়ক টেন্ডা বাভুমার কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে৷ কলকাতার পিচে স্পিন ধরবে, সেটা ম্যাচ শুরুর আগেই বলছিলেন ধারাভাষ্যকাররা৷ বাভুমা যদি স্পিনারদের শুরু থেকে নিয়ে আসতেন, হেড আর ডেভিড ওয়ার্নার ৬০ রানের ওই বিস্ফোরক শুরুটা হয়তো পান না৷ ২১৩ রানের লক্ষ্য তাড়ায় হয়তো সেই ওপেনিং জুটিটাই গড়ে দিয়েছে পার্থক্য৷ 

শট খেলার মুহূর্তে মিলার
মিলার যা করেছেন, সেটা প্রোটিয়াদের হয়ে আর কেউ করতে পারেনিছবি: Andrew Boyers/REUTERS

বাভুমার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন আরও বেশি উঠছে, কারণ সপ্তম ওভারে পার্টটাইম স্পিনার মার্করাম এসেই প্রথম বলে ফিরিয়েছেন ওয়ার্নারকে৷ এবং দলের সেরা স্পিনার কেশব মহারাজকে ১৫তম ওভারে এনেছেন বাভুমা৷ মহারাজও প্রথম বলে হেডকে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, তাকে হয়তো আরও আগে আনা যেত৷ 

সাউথ আফ্রিকার এত সব আক্ষেপ আর অতৃপ্তির বিষাদ সিন্ধুতে ম্লান মুখে উঁকি দেবে অবশ্যই ডেভিড মিলারের নাম৷ এই উইকেটে তিনি যে ইনিংস খেলেছেন, সেটাকে মার্ক ওয়াহর মতো অনেক সাবেকই বলছেন বিশ্বকাপ নকআউটের অন্যতম সেরা ইনিংস৷ দলের ২৪ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর তিনি হাল ধরেছেন, শেষ পর্যন্ত আউট হয়েছেন ১০১ রান করে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পূর্বসূরি ল্যান্স ক্লুজনারের মতো তো ট্র্যাজেডির নায়কই৷

অথচ মিলার যা করেছেন, সেটা প্রোটিয়াদের হয়ে আর কেউ করতে পারেনি৷ বিশ্বকাপের সেমিতে সেঞ্চুরি ছিল না সাউথ আফ্রিকার কারও৷ মিলার আজ এমন এক সময় সেটি পেলেন, যখন মিচেল স্টার্ক আর জশ হ্যাজলউডের তোপে কাঁপছে সাউথ আফ্রিকা৷ হেইনরিখ ক্লাসেনের সাথে তার ৯৫ রানের জুটিটা বড় কিছুরই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল আফ্রিকাকে৷ কিন্তু এরপরেই রঙ্গমঞ্চে আজকের ম্যাচের নায়ক হেড৷ প্যাট কামিন্স নিয়মিত স্পিনার জাম্পা, অনিয়মিত স্পিনার ম্যাক্সওয়েল, পেসার স্টার্ক, হ্যাজলউড বা নিজে চেষ্টা করেও মিলার-ক্লাসেনের জুটি ভাঙতে পারছিলেন না৷ সেটা হেড এসে ক্লাসেনকে বোল্ড করলেন, আর পরের বলে ফেরালেন ইয়ানসেনকে৷ সাউথ আফ্রিকার বড় কিছুর আশা আসলে ওখানেই শেষ৷ 

তারপরও মিলার হাল ছাড়েননি৷ টেল এন্ডারদের নিয়ে লড়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত, ১১৯ রানে ষষ্ঠ উইকেট পড়ার পর তাদের নিয়ে যোগ করেছেন ৮৪ রান৷ কিন্তু এর মধ্যে আবার ফিরে এলো আরেক আক্ষেপ৷ জেরাল্ড কোটজিয়া বেশ ভালো সঙ্গ দিচ্ছিলেন মিলারকে, দুজনের ৫৩ রানের জুটিটা বেশ জমে উঠেছিল৷ কিন্তু কামিন্সের বলে কোটজিয়া আউট হয়ে গেলেন উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে৷ অথচ রিপ্লেতে দেখা যায় বল তার কাঁধে লেগেছে৷ কিন্তু রিভিউ না নিয়ে ফিরে গেছেন কোটজিয়া৷ তখন মিলারের সাথে আর কিছুক্ষণ ক্রিজে থাকলে আফ্রিকার রান আরেকটু বেশি হতে পারত৷ ম্যাচের গল্পটাও হয়তো অন্যরকম হতে পারত৷ 

আর সাউথ আফ্রিকার নকআউট ম্যাচে বৃষ্টি হানা দেবে না, সেটা হতেই পারে না৷ ১৯৯২ সালের সেই সেমির মতো আজ অবশ্য বৃষ্টি অবিশ্বাস্য কোনো সমীকরণ দাঁড় করিয়ে দেয়নি৷ কিন্তু আফ্রিকার জন্য সমীকরণ একটু ওলট পালট করে তো দিয়েছেই৷ বৃষ্টির চোখরাঙানিতে মেঘলা আবহাওয়ার পরেও টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন বাভুমা৷ কামিন্স বলেছেন, তিনিও সেই সিদ্ধান্তই নিতেন৷ কিন্তু টসে হারাটাই অস্ট্রেলিয়ার জন্য হয়ে এসেছে শাপেবর৷ নতুন বলে স্টার্ক আর হ্যাজলউড মিলে নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছেন সাউথ আফ্রিকার৷ বাভুমা আউট প্রথম ওভারেই, কোনো রান না করে৷ কুইন্টন ডি কক এই বিশ্বকাপে দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন, আজও তার ব্যাটের দিকেই তাকিয়ে ছিল দল৷ কিন্তু জশ হ্যাজলউডকে উড়িয়ে মারতে গেলেন, মিড অনে থেকে দৌড়ে দারুণ এক ম্যাচ নিলেন কামিন্স৷ ডি কক ফিরলেন ৩ রানে৷ এখানেই বোধ হয় ম্যাচের লাগামটা নিয়ে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া৷ 

উইকেট নেয়ার পর স্টার্ক
সাউথ আফ্রিকার রান তোলার পথে বাধা তৈরি করা বোলারদের অন্যতম স্টার্কছবি: Andrew Boyers/REUTERS

সাউথ আফ্রিকাকে এতোটাই বেঁধে রেখেছিলেন স্টার্ক-হ্যাজলউড, তাদের প্রথম বাউন্ডারি পেতে অপেক্ষা করতে হলো নবম ওভার পর্যন্ত৷ সেটা যার ব্যাট থেকে এলো, সেই এইডেন মার্করামও টেকেননি বেশিক্ষণ৷ স্টার্কের বলে আউটসাইড এজ হয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ডেভিড ওয়ার্নারকে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ১০ রানে৷ পরের ওভারে রেসি ভ্যান ডার ডুসেনের ৬ রানের সংগ্রামী ইনিংসটাও শেষ হলো হ্যাজলউডের বলে ক্যাচ দিয়ে৷ যে আফ্রিকা বিশ্বকাপে হেসেখেলে ৩০০ তুলেছে, টপ অর্ডারের প্রায় সবাই ছিলেন রানে; তারাই ২৫ রানের ভেতর ৪ উইকেট হারিয়ে বড় স্কোরের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে বসেছে৷

কিন্তু এরপরও তো সুযোগ ছিল৷ ওয়ার্নার-হেডের অমন ওপেনিং জুটির পরও তো তারা ফিরে এসেছিল দারুণভাবে৷ ভ্যান ডার ডুসেনের অসাধারণ এক ক্যাচে মার্শের আউট আশা দেখাচ্ছিল তাদের৷ যে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবারের বিশ্বকাপের তো বটেই, ওয়ানডেরই অন্যতম সেরা ইনিংস খেলেছেন, তাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল ১ রানে৷ মধ্যে মহারাজ আর শামসি যখন বল করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল যে কোনো কিছুই সম্ভব৷ কিন্তু মহারাজ আর শামসিকে দেখেশুনে খেলা ফেলার পর অসিদের কাজটা সহজ হয়ে যায়৷ স্মিথ আর জস ইংলিসের কেউই শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি, কিন্তু কামিন্স আর স্টার্কের জন্য বাকি কাজটা শেষ করা কঠিন হয়নি৷ 

শেষ পর্যন্ত তাই ১৯৩ রানে ৭ উইকেট হারিয়েও জয় পেয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া৷ আর আরও একবার পৌঁছে গেছে বিশ্বকাপ ফাইনালে, ‘মাইটি অসিদের' হাতছানি দিচ্ছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ষষ্ঠ মুকুট৷

সংক্ষিপ্ত স্কোর :

সাউথ আফ্রিকা ৪৯.৪ ওভারে ২১২ (মিলার ১০১, ক্লাসেন ৪৭; স্টার্ক ৩/৩৬, কামিন্স ৩/৫১, হ্যাজলউড ২/১২)

অস্ট্রেলিয়া ৪৭.২ ওভারে ২১৫-৭ (হেড ৬২, স্মিথ ৩০, ওয়ার্নার ২৯; শামসি ২/৪২, কোটজিয়া ২/৪৭)

ফল: অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী

ম্যাচসেরা: ট্রাভিস হেড