পহেলা বৈশাখে মোটর বাইকে শুধুই স্বামী-স্ত্রী?
১৩ এপ্রিল ২০১৯পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন নিয়ে উগ্র ইসলামপন্থিরা বরাবরই নেতিবাচক মন্তব্য করছে৷ কিন্তু এবার বাংলা নববর্ষে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া মটরবাইকে একসঙ্গে আরোহী হওয়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আলোচনায় এসেছে সিলেট মহানগর পুলিশ৷
এদিকে, বিকাল ৫টার মধ্যে পহেলা বৈশাখের সব আয়োজন শেষ করতে বলা, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে মুখোশপরাসহ নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে প্রশাসন৷ আর এত নিষেধাজ্ঞার কারনে পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন উদযাপনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে৷
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এবারের পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ১৩ দফা নির্দেশনা জারী করেছে৷ এরমধ্যে অন্যতম হলো, পহেলা বৈশাখের দিন স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কেউ একসঙ্গে মটরবাইকে আরোহণ করতে পারবে না৷
নয় নম্বর নির্দেশনায় সিলেট পুলিশ বলছে, ‘‘মোটরসাইকেলে চালক ব্যতিত অন্য কোন আরোহী বহন করা যাবে না৷ তবে স্বামী-স্ত্রী চলাচল করতে পারবেন৷ একযোগে বা দলগতভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি বা যান চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না৷''
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রার যে আয়োজন করা হয় তা ইসলামী শরিয়ত সমর্থন করে না৷ কোন ঈমানদার মুসলমান মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘মানুষের জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গল-অমঙ্গল সবকিছুই আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তাআলার হুকুমে হয়৷ পৃথিবীর সব বিশ্বাসী এটাই বিশ্বাস করেন৷ কোন মূর্তি, ভাস্কর্য, পোস্টার, ফেস্টুন ও মুখোশে মঙ্গল-অমঙ্গল থাকতে পারে না৷ বাঘ, কুমির, বানর, পেঁচা, কাকাতুয়া, ময়ূর, দোয়েলসহ বিভিন্ন পশুপাখি মঙ্গল আনতে পারে না৷ এসব বিশ্বাস যেমন ইসলামি শরীয়তবিরোধী চেতনা, তেমনি বর্তমান আধুনিক সময়ে মূর্তি-ভাস্কর্য ও জীবজন্তুর ছবি নিয়ে মঙ্গল-অমঙ্গল কামনা করা একটি কুসংস্কারচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণ৷''
এর আগে ওলামা লীগ ২০১৬ সালে ঢাকায় এক মানববন্ধন ও সমাবেশে বলেছিল, ‘‘পহেলা বৈশাখে উৎসব উদযাপন ইসলাম বিরোধী৷'' সংগঠনের নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘‘পহেলা বৈশাখের নামে দেশে কোন বেহায়াপনা সহ্য করা হবে না''
তারা আরও বলেন, ‘‘ইসলামে পহেলা বৈশাখ ও পহেলা জানুয়ারি তারিখে নববর্ষ পালন জায়েজ নয়৷'' তাই রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের দেশে হারাম দিবস পালনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করার আহবান জানান তারা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন এবং পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রার সদস্য সচিব অধ্যাপক নিসার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওরা মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে যত বলে আমাদের আগ্রহ তত বেড়ে যায়৷ আমাদের কাছে মনে হয় আমরা ভালো কিছু একটা করছি৷ কারণ তারা ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারাতো ধার্মিক নয়, ধর্ম ব্যবসায়ী৷ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে৷ উদার ও মানবিক সংস্কৃতির যত বিকাশ হবে তারা ততই হারিয়ে যাবে৷ তাই তারা পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলে৷ তবে আমরা এগুলোকে গুরুত্ব দেইনা৷''
এদিকে, এ বছর বিকেল ৫টার মধ্যে পহেলা বৈশাখের সব আয়োজন শেষ করতে বলেছে পুলিশ৷ অনুষ্ঠান আয়োজন বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরেই এ ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে প্রশাসন৷ পাশাপাশি পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় বা কেনো অনুষ্ঠানে মুখোশ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ যেন উৎসবের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে পারে সেজন্য সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে৷''
অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের কাছে পুলিশের একটি সাধারণ নির্দেশনা আছে৷ আমরা সেটা মেনেই নববর্ষের আয়োজন করি৷ কিন্তু সিলেটের পুলিশ আলাদাভাবে যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটাকে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন বলেই মনে হয়েছে৷ এটা সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলবে৷ আর সিলেটের মানুষ চাইলে এর প্রতিবাদ করতে পারেন৷ আইনগত ব্যবস্থাও নিতে পারেন পুলিশের এই আদেশের বিরুদ্ধে৷''
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পারিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিলেট মহানগর পুলিশ যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে উগ্রবাদ উৎসাহিত হবে৷ তাদের এই নির্দেশনার কারণে এক ধরনের আশঙ্কা তৈর হবে যা উগ্রবাদের জন্য সহায়ক৷ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নববর্ষে একই মোটর বাইকে আরোহী হতে পারবেনা - এটা রাষ্ট্রীয় আইন বিরোধী৷ অনেক সময় পুলিশ ‘পাবলিক নুইসেন্স' কমানোর জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে৷ কিন্তু এই নির্দেশনাকে সেভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই৷ এটি নাগরিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যায়৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘পহেলা বৈশাখসহ বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম ও আরো কিছু সংগঠন শুধু এবার নয়, দীর্ঘদিন ধরেই বিষোদগার করে আসছে৷ আর দেখে শুনে মনে হয়ে তারা সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে৷ তাদের আসলে এখন থামানোর সময় এসেছে৷ তাদের এই বিষোদগার চলতে দিলে দেশের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা আছে৷''
তবে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার জেদান আল মুসা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পহেলা বৈশাখে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া একাধিক ব্যক্তিকে একই মটরবাইকে আরোহী হতে নিরুৎসাহিত করেছি৷ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিনি৷ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতেই এটা করা হয়েছে৷ কারণ, অতীতে দেখা গেছে ২০-২৫ জন মিলে মটরবাইকে চড়ে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে৷ মোটরসাইকেলে থাকা পিছনের আরোহী অনেক সময় ছিনতাই করে৷ এগুলো প্রতিরোধই আমাদের উদ্দেশ্য৷ অন্যকোনো উদ্দেশ্য নেই৷''