কেন দু’দিনে পহেলা বৈশাখ?
১৬ এপ্রিল ২০১৮ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল ধরে রাখার কী কারণ?
ফরহাদ খান: অবিভক্ত বঙ্গদেশে নবদ্বীপের পণ্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা সংস্করণ করেন৷ এরপর ১৮৬৯ সালে আবারও সংস্করণ হয়৷ পরে সেটা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়৷ এরপর ১৮৯০ সালে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকার প্রকাশ চলতে থাকে৷ ১৯৫২ সালে মেঘনাদ সাহাকে ভারত সরকার পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেন৷ তিনিই শকাব্দ সংস্কার করেন৷ সেই শকাব্দ অনুযায়ী পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল৷ মেঘনাদ সাহার এই সংস্কার বাংলাদেশেও ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল৷ ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি ড. শহীদুল্লাকে সভাপতি করে পঞ্জিকা সংস্কার শুরু করে৷ আগে ৩০, ৩১, ৩২ দিন ছিল৷ তারপর ঠিক হয়, প্রথম ৫ মাস ৩১ দিনের, বাকি ৭ মাস ৩০ দিনের হবে৷ এরপর ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আবারো পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়৷
সেই পঞ্জিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত৷ এতে বৈশাখ থেকে ভাদ্র হলো ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র হলো ৩০ দিনে আর খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনের হবে৷ অর্থাৎ যে বছর খ্রিষ্টীয় সনে লিপ ইয়ার, সে বছর বাংলা সনেও লিপ ইয়ার৷ এ সংস্কারের ব্যাপারটি যখন আনা হয়, তখন আমাদের গৌরবময় মাস, আমাদের শোকের মাস, আমাদের বিজয়ের মাস, ১৯৭১ সালকে মনে রাখা হয়েছিল৷ ১৯৭১ সালে আমাদের যেমন ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি – এর যে প্রতিসঙ্গী খ্রিষ্টীয় সবের দিনগুলো, সেগুলোকে এক রাখার জন্যই বাংলা একাডেমি এই সংস্কারটা করে৷ এতে এখন যেটা দাঁড়িয়েছে, সরকারি পঞ্জিকা অনুসারে ২১শে ফেব্রুয়ারি হলো ৯ই ফাল্গুন, ২৬শে মার্চ হলো ১২ই চৈত্র এবং ১৬ই ডিসেম্বর হলো ২রা পৌষ৷ এর কোনোদিন এর হেরফের হবে না৷
পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের কোনো সংস্কার শুরু হয়েছিল? বাংলাদেশের নববর্ষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কোনো চেষ্টা কি হয়েছিল?
শঙ্করলাল ভট্টাচার্য: মেঘনাদ সাহার সময়েই একবার পঞ্জিকা সংস্কার হয়েছিল৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিবার থেকেই পঞ্জিকা সংকলিত হয়েছে৷ ঘটনাচক্রে যুগের সাথে পঞ্জিকা দর্শন বা পঞ্জিকা বিচার আস্তে আস্তে ফুরিয়ে এসেছিল৷ তার সঙ্গে ৬৭ সালে বামপন্থা যুগের সাথে মিলেমিশে গিয়েছিল৷ বিবর্তনের ফলে বিয়েশাদী বা পুজোর দিনক্ষণে শুধু পঞ্জিকা দেখা হতো৷
বাংলাদেশে নিয়মিত ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালিত হয়৷ আর পশ্চিমবঙ্গে কখনও ১৫ এপ্রিল বা কখনও ১৪ এপ্রিল পালিত হয়৷ একইদিনে পালন করার ইচ্ছে কি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের হয় না?
শঙ্করলাল ভট্টাচার্য: বিভাজন শুধু কাঁটাতারের নয়৷ বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য বইটিতে আহমেদ শরীফ সাহেব বলেছেন, এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অর্থে মধ্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হয়নি৷ কারণ মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্য নিয়ে যথেষ্ট জিজ্ঞাসু হননি কলকাতার লেখকরা৷ ফলে বিভাজনটা রয়ে গেছে চেতনাতেও৷ সারাবার চেষ্টাও করছি না আমরা৷
ফরহাদ খান: বাংলাদেশে কিন্তু দু'টো পঞ্জিকাই চালু আছে৷ মেঘনাদ সাহা ধর্মীয় পঞ্জিকা চালু করার কথা বলেছিলেন৷ সেটা তিনি পারেননি৷ বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিমদের ধর্মাচরণের পার্থক্য আছে৷ বাঙালি হিন্দুদের তিথি, নক্ষত্র, দণ্ড, পল – এ সব হিসেব করতে হয়৷ এখন যে সন বাংলাদেশ ব্যবহার করছে, তাতে হিন্দুদের ধর্মাচরণে অসুবিধা আছে৷ তাই এখানে সমান্তরালে ধর্মীয় ক্যালেন্ডারও আছে৷ বাংলা সন একইসাথে চান্দ্রেয় সন এবং সৌরসন৷ বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসবের এবং দিনের৷ পয়লা বৈশাখকে সেভাবেই দেখা হয়েছে৷ সবাই এদিন অংশগ্রহণ করেন৷
বাংলা সন শুরুর ইতিহাসটা একটু বলুন...
ফরহাদ খান: বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল ফসলি সন হিসেবে৷ যে বছর সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসেন, সে বছরই শুরু হয়েছিল, ১৫৫৬ থেকে৷ হিসেব করা হয়েছিল হিজরী সন ধরে৷ হিজরী সন ৯৬৩ কে ধরেই শুরু হয়েছিল বঙ্গাব্দের হিসেব৷
বাঙালির জন্য পয়লা বৈশাখ উদযাপন কি এখনও জরুরি?
ফরহাদ খান: বাংলাদেশের জন্য বাঙালির জন্য একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দিনের খুব প্রয়োজন৷ যে দিনটিতে সব ধর্মের মানুষ একই রঙে রং মেলাতে পারেন৷ শোক এবং রক্তঝরা ইতিহাসে বাংলাদেশের বাঙালির চেতনায় শোক শক্তিতে এবং শক্তি উৎসবে পরিণত হয়েছে৷ তাই পয়লা বৈশাখ উৎসবে পরিণত হয়েছে৷ একইরকমভাবে ২১ ফেব্রুয়ারির বইমেলাও উৎসবে পরিণত হয়েছে৷
শঙ্করলাল ভট্টাচার্য: আকবরী জমানা থেকে বর্ষবিচার শুরু হওয়ায় আর্থিক যোগ ছিল প্রথম থেকেই৷ ধর্মের যোগ আসেনি৷ কলকাতায় হালখাতা বলে উদযাপন করা হয়৷ সব জায়গায় দোকানিরা খেরোর খাতা নিয়ে গিয়ে কালীঘাটে পুজো দেয়৷ অর্থভাগ্য ভালো হওয়ার জন্য আবার মন্দিরে যাওয়া শুরু হল৷ পয়লা বৈশাখে কোনো হিন্দুয়ানিও নেই, আবার ইসলামি সংস্পর্শও নেই৷ এটা বঙ্গের কালচার৷ তবে কলকাতার বইপাড়ায় আগে যে উদযাপন হত বই ও পত্রিকা প্রকাশ করে, এখন সেটা আয়েসি এবং একঘেঁয়ে ভোগীচেহারা হয়ে গেছে৷ অনেকটা ক্যালেন্ডার উদযাপন বলা যেতে পারে৷ সে তুলনায় বাংলাদেশের চেহারা অনেকটাই আলাদা যে তাতে সন্দেহ নেই৷ তবে বলতে হবে এই বিতর্ক থাকবেই৷ চলতে থাকবে ১৪ এপ্রিল ও ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন৷
সাক্ষাৎকারটি ২০০৬ সালে নেয়া...
সাক্ষাৎকার: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক
অনুলিখন: পায়েল সামন্ত
পুরো আলোচনাটি শুনুন অডিওতে৷ কেমন লাগলো লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷