বর্ষবরণ উৎসব
১৪ এপ্রিল ২০১৫শেরপুরের সোহাগপুরের বিধবা পল্লীতে স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বাংলা নববর্ষ পালিত হলো৷ ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল সুর ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে'- এবার ছড়িয়ে পড়েছে সোহাগপুরেও৷
মুক্তিযুদ্ধে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রাম এক বেদনাবিধুর অধ্যায়৷ যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই ঐ গ্রামে ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়৷ এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের কারণে গ্রামের অধিকাংশ বিবাহিত নারী বিধবা হন৷ তখন থেকে গ্রামটির নাম হয়ে যায় বিধবা পল্লী আর থেমে যায় উৎসব, মুছে যায় জীবনের রং৷ বিধবা নারীদের কান্না সঞ্চারিত হয় বছরের পর বছর ধরে৷ তাই স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরে ওই গ্রামে কখনো বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ পালিত হয়নি৷
কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম হল৷ বাংলা নববর্ষের মাত্র কয়েকদিন আগে সোহাগপুর গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে৷ অপরাধীর শাস্তি হওয়ায় ওই গ্রামের মানুষ এখন খুশি৷ তাই এবার বাংলা নববর্ষ পালিত হয়েছে সেই গ্রামে৷ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেই আয়োজনের সঙ্গে ছিল বিধবা পল্লী শহীদ স্বজন সমিতি৷
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে একটি দল বাসে করে সোহাগপুর যায়৷ তাঁরা সাথে করে নিয়ে যান নতুন শাড়ি, লুঙ্গি, মিষ্টি, দই আর শুকনা খাবার৷
বিধবা পল্লী শহীদ স্বজন সমিতির সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন জানান, পহেলা বৈশাখ সকালে বিধবা ও স্বজনরা শহিদদের জন্য নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পণ করেন৷ পরে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলাকাবাসী ঢাকা থেকে যাওয়া গণজাগরণ মঞ্চের সদস্যদের পান্তা দিয়ে আপ্যায়িত করেন৷ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ আর সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হিসেবে থাকেন একাত্তরে স্বামী হারানো বিধবারা৷ গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধিরা স্বজন হারানোদের সঙ্গে কথা বলেন, শোনেন তাঁদের বেদনা আর কষ্টের কথা৷ তাঁরা চেষ্টা করেন নতুন বছরের নতুন আলোয় তাঁদের নতুনের পথ দেখাতে৷
ঢাকায় বর্ষবরণ
ঢাকায় ছায়ানটের বর্ষবরণ শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই৷ রমনা বটমূলে পণ্ডিত রবি শংকরের সৃষ্ট রাগ ‘পরমেশ্বর' আলাপ জোড় পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ শুরু হয়৷ তারপর সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত -অম্বর-মাঝে/দিকে দিগন্তরে ভুবন মন্দিরে শান্তি সঙ্গীত বাজে'৷
ছায়ানটের এবারের বর্ষবরণের প্রতিপাদ্য ‘শান্তি, মানবতা, মানুষের অধিকার'৷ জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে অতীতের সকল জীর্ণতাকে পেছনে ফেলে শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন৷
মঙ্গল শোভাযাত্রা
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ মানুষের কোলাহল, হর্ষধ্বণি, গান ও ঢাকঢোল মিলে তৈরি হওয়া ঐকতানে অভূতপূর্ব এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়৷ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কবিতা থেকে নেয়া ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে' শ্লোগান ধারণ করে চারুকলা অনুষদের দ্বিতীয় ফটকের সামনে থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা৷
শোভাযাত্রায় অতিথি হিসেবে অংশ নেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও থাইল্যান্ডের সংস্কৃতিমন্ত্রী উইরা রাজপুটচানারাত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হুসেইনসহ আরও অনেকে যোগ দেন এই শোভাযাত্রায়৷
অপশক্তির বিরুদ্ধে আপামর জনগণ রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক রূপে শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকৃতির হাতি৷ শোভাযাত্রায় আরো বহন করা হয় বিশালকৃতি মাছ, টেপা পুতুল, কাকতাড়ুয়া, পাখি, দুই বাছুর ছানাসহ গাভী, পেঁচা, বাঘ ইত্যাদি৷ রং-বেবংয়ের মুখোশ পড়ে অংশ নেন সব শ্রেণির মানুষ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘এই মঙ্গল শোভাযাত্রা অসুর বিনাশী, আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে আলোর পথে নিয়ে যায়৷'' তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে আমরা নতুন করে প্রাণশক্তি অর্জন করি, নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি৷''
শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ পেরিয়ে সাবেক রূপসী বাংলা হোটেল পর্যন্ত গিয়ে ঘুরপথে টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে চারুকলা অনুষদের প্রধান ফটকে গিয়ে শেষ হয়৷
শহরজুড়ে বর্ষবরণ
বাংলা নববর্ষ বরণ যেন পুরো শহর জুড়েই৷ রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন স্থানে চলে নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের গানের আসর ও বৈশাখী মেলা৷ এসব আয়োজনে সবার অংশগ্রহণ প্রমাণ করে বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ৷
বর্ষবরণে সকালে চারুকলার সামনে কথা হয় ঢাকার ধানমন্ডির ফেরদৌস আরার সঙ্গে৷ তিনি তাঁর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ দেন৷ তিনি এবং তাঁর দুই শিশু সন্তানের সাজ পোশাক যেন বাংলা নববর্ষের এক ছোট প্রতীক৷ বললেন, ‘‘আমার সন্তানরা বাঙালি৷ ওদের এখন থেকেই বাঙালি করার চেষ্টা করছি৷ এই উৎসব, এই আয়োজন ওদের পথ দেখাবে, শেখাবে সার্বজনীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা৷''
বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে অংশ নিতে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও৷ তারাও সেজেছেন বাঙালিয়ানা পোশাকে৷ তারাও কান পেতে শুনেছেন বঙালির প্রাণের উৎসবের আহ্বান, শক্তি৷
এবার রাজনৈতিক অস্থিরতার সদ্য অবসানের পর এই বর্ষবরণ হওয়ায় মানুষের ঢল বরাবরের চেয়ে একটু বেশিই মনে হয়৷