‘পহেলা বৈশাখ জাতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উদযাপিত হোক'
১৭ এপ্রিল ২০১৮ডয়চে ভেলে: পহেলা বৈশাখ কীভাবে এলো?
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক: পহেলা বৈশাখ ঢাকা শহরে আগে উদযাপন করা হতো না৷ গ্রামাঞ্চলে অনেক জায়গায় ছিল, যদিও সেগুলোর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ বাংলা সন যখন থেকে শুরু হয়, তখন থেকেই হয়ত গ্রামে কোথাও কোথাও এটা উদযাপন হতো৷ তবে তখন উদযাপনের ধরন ভিন্ন ছিল৷ গ্রামে তখন ছেলে-মেয়েরা খেলনা কিনতো৷ জিলাপি বিক্রি হতো৷ মেলার সঙ্গে কিছু খেলাধূলাও ছিল৷ অনেক জায়গায় জুয়া খেলা হতো৷ ঢাকা শহরে প্রথম পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ১৯৬৮ বা ১৯৭০ সাল থেকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি প্রথম এটা উদযাপন করে৷ তখন ছ'দফার ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত প্রবল ছিল৷ শিক্ষক সমিতির পাশাপাশি ছায়ানটেও প্রায় একই সময়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়৷ তখন মূল কথা ছিল, আমরা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নই, আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী৷ এ কারণে পহেলা বৈশাখে আলোচনাসভা, কোথাও কোথাও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো৷ দেশ স্বাধীনের পর এটা ভিন্ন রূপ পায়৷ ছায়ানট রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান শুরু করে৷ একই সঙ্গে ইলিশ মাছের তরকারি দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়াসহ অনুষ্ঠানগুলো শুরু হয়ে যায়৷
পহেলা বৈশাখ বাঙালির কাছে এত প্রিয় হলো কীভাবে?
দেশ স্বাধীনের আগে ২-৩ বছর ধরে এটা হচ্ছিল৷ এমনকি ৫২ সাল থেকেই এই চেতনা কাজ করছিল৷ পাশাপাশি রমনার বটমূলে যখন অনুষ্ঠান শুরু হলো, তখন এটাতে লোক সমাগম বাড়তে থাকে৷ দেশের মানুষও তখন বাড়ছিলে৷ এটা তখন প্রদর্শনীয় মতো হয়ে গেল৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে যেটা শুরু হয়েছিল, তখন এটা তেমন কি আর থাকলো? আওয়ামী লীগ ক্ষমতার থেকে যাওয়ার পর জিয়াউর রহমান বা তারপর এরশাদ যখন ক্ষমতায় এলো, তখন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের উৎসাহ কমে গিয়েছিল৷ তখন আওয়ামী লীগ পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নেয়৷ তারা তখন অনুষ্ঠান করতে থাকে৷ এরপর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান নিয়ে একটা অংশ বলছে, এটা একামাত্র ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান৷ আরেকটা অংশ বলছে, পহেলা বৈশাখ যেভাবে উদযাপন হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়৷ গ্রামাঞ্চলে যেভাবে হতো, সেভাবে হলেই ঠিক হতো৷ ১৯৮০-র দশকে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে, তখন পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে আওয়ামী লীগ এটাকে সামনে আনতে চাইছিল৷ তখন চারুকলা বিভাগ থেকে মুখোশ পরা, মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান শুরু হয়৷ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল তো পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে উৎসাহ বোধ করে না৷
মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে...
এতে তেমন কোনো লাভ হয়নি৷ ইউনেস্কোকে আসলে এত বড় করে দেখা ঠিক নয়৷ তদবির করে ইউনেস্কো দ্বারা অনেক কিছুই করানো যায়৷ পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য এটাকে রক্ষা করতে হবে – এই কথা তো ঠিক নয়৷ পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় ঐহিত্য কবে থেকে হলো? এক সময় গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে৷
তার প্রতিকৃতি তৈরি করে তার গায়ে ঢিল ছুঁড়েছে৷ কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক শওকত ওসমান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীসহ আরো অনেকে৷ এই ঢিল ছোঁড়া, এর মধ্যে কি জাতীয় চেতনা আছে? পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করা কি আমাদের ঐহিত্যের অন্তর্গত? পহেলা বৈশাখ নিয়ে ইউনেস্কো যা বলছে, সেটা ঠিক নয়৷ ইউনেস্কো সাম্রাজ্যবাদী একটা শক্তি হয়ে গেছে৷ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে বিলীয়মান মাতৃভাষা রক্ষার চেষ্টা করছে ইউনেস্কো৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে বিলীয়মান মাতৃভাষা রক্ষা করা যাবে না৷ যেগুলো বিকাশমান মাতৃভাষা, সেগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, উন্নত করা যায়, সব জাতি সমানভাবে কীভাবে সভ্যতার দিকে যেতে পারে, সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার৷
পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ ও পান্তা ভাতের সম্পর্কটা কী?
এটা তো ঢাকা শহরের ভদ্রলোকেরা '৭২ সাল থেকে করতে আরম্ভ করেছে৷ গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মেলা করেছে৷ সেখানে পান্তা ভাত বা ইলিশ মাছ খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না৷
পহেলা বৈশাখের আয়োজনটা কেন মূলত রমনা বটমূলেই হয়?
রমনার বটমূলে হওয়ার বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই৷ একটা অনুষ্ঠান করার জন্য প্রসারিত জায়গা দরকার হয়৷ এখানে যে পার্ক, সেটাকে বেছে নেয়া হয়েছে৷ অন্য কিছু না৷ পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমিতেও এই অনুষ্ঠান হচ্ছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো কোনো বিভাগ করছে৷
সামনের পহেলা বৈশাখ ঘিরে আপনার প্রত্যাশা কী?
আমি চাই পহেলা বৈশাখ জাতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উদযাপিত হোক৷ গানের অনুষ্ঠান হতে পারে, বাড়িতে সাবাই ভালো খাওয়া-দাওয়া করতে পারে৷ আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো যেতে পারে৷ কোনো পার্কে বা মাঠে পহেলা বৈশাখ উৎযাপিত হতে পারে৷ কিন্তু যে উদযাপনের পেছনে পুলিশ বা র্যাব বা বিজিবি দরকার হয়, সে উদযাপন ঠিক হচ্ছে না৷
সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷