মোদীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে গুজরাট
২৫ অক্টোবর ২০১৭‘গুজরাট মডেল’-কে সামনে রেখেই সাড়ে তিন বছর আগে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি৷ গুজরাটের রূপকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল সেই রাজ্যের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী, তথা প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীকে৷ চলতি বছরেই গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচন৷ অর্থাৎ, রাজ্যের শাসনভার কার ওপর বর্তাবে, তা নির্ধারণ করবেন গুজরাটের আম জনতা৷ কিন্তু, এবার সম্ভবত গুজরাট মডেলের ফানুস ফুটো হয়ে গেছে৷ মোদী বা তাঁর দলের কেউই আর ভোট ভিক্ষা করতে গিয়ে গুজরাট মডেলের কথা বলছেন না৷
হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা করলেও গুজরাটে ভোটের দিন জানায়নি নির্বাচন কমিশন৷ এতেই সুবিধা পেয়ে গেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি৷
বেশ কয়েকদিন যাবত শুধু শিলান্যাস আর উদ্বোধন করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ উদ্বোধন করা, যেটা পঞ্চায়েত ও পুরসভার কাজ, তা-ই করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে!! দেখা গেল, একটি স্কুলে গেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ সেখানে ছাত্রছাত্রীরা মাটিতে বসে রয়েছে৷ নিন্দুকরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে উন্নয়নটা কোথায় হয়েছে? উল্টে, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ'র ছেলে জয় শাহ'র কোম্পানির অবিশ্বাস্য সাফল্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷
সিপিএম সাংসদ মোহাম্মদ সেলিম বলছেন, এবার গুজরাট থেকেই মোদীর পতন শুরু হতে চলেছে৷ গুজরাট থেকে শুরু, গুজরাট থেকেই শেষ হবে বিজেপি৷
তাঁর কথায়, ‘‘২০০২ সালে গুজরাটে গণহত্যার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদীর উত্থান হয়েছে৷ তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ৷ পরে তিনি ক্লিনচিট পেয়ে গেছেন৷ এখন দেশের এমন অবস্থা যে, ব্যবসায়ী, সিনেমা নির্মাতা, অভিনেতা, সাংবাদিক যে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই শায়েস্তা করার চেষ্টা হচ্ছে৷ এমনকি খুন হতে হচ্ছে৷ এর পাশাপাশি সরকার আশ্রিতদের লুটের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হচ্ছে৷’’
তবে, সেলিম যা-ই বলুন না কেন, এই মুহুর্তে গোটা দেশে নরেন্দ্র মোদী অথবা বিজেপি'র হাওয়া যে অনুকূলে বইছে না, সাধারণ সংবাদকর্মী হিসেবে সেটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না৷ রাজনীতির সহজ হিসেব অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এই হাওয়া বদলে যেতেও সময় লাগবে না হয়ত৷ আসলে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তিলে তিলে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে সাধারণ মানুষের মনে৷ বেকারত্ব, ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা, গো-রক্ষা বাহিনীর নামে নিরীহদের পিটিয়ে খুন করা, আচমকা ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে সাধারণ মানুষকে অসহনীয় যন্ত্রণার মুখে ঠেলে দেওয়া এবং পণ্য ও পরিষেবাকর চালু করার বিষয়গুলি ভালোভাবে নেয়নি দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা৷ চটেছে ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ৷ সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, কালোটাকা শেষ হয়ে যাবে৷ দুর্নীতি বলে আর কিছু থাকবে না৷ সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস হবে৷ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে দেশ৷ কিন্ত, কোথায় কি৷ বিমূদ্রাকরণের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে৷ একাধিক সমীক্ষা এবং সরকারি হিসেবেই বলছে, দেশের অর্থনীতি যেখানে ছিল, তার থেকে অধঃপতন হয়েছে৷ একচুলও অগ্রগতি হয়নি৷
সবমিলিয়ে সমস্ত ভারতবাসীর নজর আটকে রয়েছে গুজরাটে৷ ভোট ভিক্ষায় সেখানে পৌঁছে গেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী থেকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী৷ তরতরিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক উষ্ণতার পারদ৷ বিজেপি'র লক্ষ্য, কমপক্ষে ১১৫টি আসন৷
টানা ২২ বছর ধরে গুজরাটে ক্ষমতা ধরে রাখার পরে বিজেপি এখন বুঝতে পারছে, এরের পরিস্থিতি অন্য রকম৷ একে তো ‘পণ্য ও পরিষেবা কর' নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা৷ এই ব্যবসায়ীরাই বিজেপির দীর্ঘদিনের ভোটব্যাঙ্ক৷ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে পণ্য ও পরিষেবা করে ছাড়সহ কিছু সুবিধা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ কিন্তু, তাতেও অবস্থা বিশেষ বদলায়নি বলে বুঝতে পারছেন মোদী, তথা বিজেপি নেতৃত্ব৷ তার মধ্যেই মোদী-অমিত শাহদের রক্তচাপ বাড়িয়ে অনগ্রসর শ্রেণীর জনপ্রিয় নেতা অল্পেশ ঠাকর কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন৷ সরাসরি কংগ্রেসে না গেলেও রাজ্যের সামাজিক আন্দোলনের আরও দুই প্রভাবশালী নেতা হার্দিক প্যাটেল এবং জিগ্নেশ মেবানিও বিজেপির বিরুদ্ধে মাঠে নামার কথা বলে চাপ বাড়িয়েছে কেন্দ্রের শাসক দলের৷ তার উপর সাম্প্রতিক একাধিক ভোটে বিজেপির হার উৎসাহ জুগিয়েছে বিরোধীদের৷
এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নের তাসেই বাজিমাত করতে মরিয়া বিজেপি৷ এবং এ কাজে তাদের প্রথম এবং শেষ টেক্কাটি সেই নরেন্দ্র মোদী৷ বিজেপি নেতৃত্ব ভালোই জানেন, কোনোভাবে গুজরাটের ফল খারাপ হলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা আরও অক্সিজেন পেয়ে যাবে৷ বিষয়টি বিলক্ষণ জানেন, মোদী নিজেও৷ সে কারণেই দিল্লি ছেড়ে বারবার গুজরাট পাড়ি দিচ্ছেন তিনি৷ গত মাসে নিজের জন্মদিনে সর্দার সরোবর বাঁধের উদ্বোধনে ‘নর্মদে সর্বদে' রণহুঙ্কার দিয়ে গুজরাট ভোটের ঢাকে কাঠি দিয়েছিলেন মোদী৷ তারপর থেকে বারবার দিল্লির রাজ্যপাট ছেড়ে ছুটে গিয়েছেন নিজের রাজ্য সামলাতে৷
অনেকেই বলছেন, পালাবদল হতে পারে৷ তবে দেখতে হবে, গুজরাটে বিরোধী দল (কংগ্রেস) কতটা সংগঠিত৷ নির্বাচন কমিশন কতদূর পর্যন্ত নিরপেক্ষ থাকে৷ সরকারি কোষাগারের টাকা ব্যবহার করে শিলান্যাসের হিড়িক পড়েছে তার প্রভাব কতটা পড়ে৷ সেইসঙ্গে অবশ্যই গোটা দেশে সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলিকে যেভাবে সরকার এবং শাসক দলের অনুগত হতে বাধ্য করা হচ্ছে, জনগণের ওপর তার কতটা কুপ্রভাব পড়ে সেদিকেও নজর থাকবে সবার৷