জিএসটি: বিভ্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা
৩ জুলাই ২০১৭বিভ্রান্তি৷ ব্যাপক এবং চূড়ান্ত বিভ্রান্তি৷ জিএসটি, অর্থাৎ দেশজুড়ে সমহারে পণ্য ও পরিষেবা কর চালু হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক মহলের প্রতিক্রিয়া এই একটি শব্দেই বর্ণনা করা যায়৷ ব্যবসায়ীরা, বিশেষত ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা সবাই বিভ্রান্ত যে, কীভাবে এই নতুন কর কাঠামোর সঙ্গে তাঁরা যুক্ত হবেন৷ এমনকি যাঁরা বাণিজ্য কর আদায় করবেন, সেই সরকারি আধিকারিকরাও জনান্তিকে স্বীকার করছেন যে, বিভ্রান্ত তাঁরাও৷ জিএসটি নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরেও তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না, কোন পণ্যের কর হার কী হবে এবং কীভাবে সেটা আদায় হবে৷ তার একটা বড় কারণ অবশ্যই বহুস্তরীয় কর ব্যবস্থা৷ পণ্য অনুযায়ী করের চারটি স্তর বেঁধে দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য দেশের মত নির্দিষ্ট একটি কর হারে জিএসটি চালু হয়নি ভারতে৷ ফলে পুজোর বাজারের মরশুম শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও শনি ও রবিবার, কলকাতা শহরের শপিং মলগুলো কার্যত খালি পড়ে ছিল৷
ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়েছিল কাগজ ও স্টেশনারি পণ্যের পাইকারি ও খুচরো ব্যবসায়ী কৃষ্ণেন্দু দের সঙ্গে৷ কলকাতার টেরিটি বাজারে তাঁদের বহু বছরের পারিবারিক ব্যবসা৷ শুক্রবার, জিএসটি চালুর আগের দিন ওই বাজারে বনধ পালিত হয়েছে৷ মমতা ব্যানার্জির সরকার পশ্চিমবঙ্গে জিএসটি মেনে না নেওয়ার যে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে, তার সঙ্গে এই ব্যবসায়ীরা একমত৷ কেন? কৃষ্ণেন্দু দে জানালেন, প্রাথমিক কারণটা ব্যবহারিক৷ আগে প্রতি তিন মাস পর পর তাঁদের ব্যবসার হিসেব দাখিল করে কর জমা করতে হতো৷
জিএসটি-র নতুন নিয়মে সেটাই করতে হবে প্রতি ১০ দিনে৷ এবং সেটাও যথেষ্ট জটিল এক হিসেব-নিকেশ, যার জন্য উপযুক্ত হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতে হবে৷ ছোট ব্যবসায়ীদের পক্ষে সেটা দুঃসাধ্য৷ আর এর জন্য যে বাড়তি খরচ হবে, তার দায় বহন করবে কে? প্রশ্ন করছেন কৃষ্ণেন্দু৷ এবং তাঁর আশঙ্কা, এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে, কারণ ব্যবসায়ীদের প্রবণতা থাকবে ওই বাড়তি খরচের ভার ক্রেতার ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়ার৷
আরও একটা অসুবিধের কথা ওরা বলছেন যে, জিএসটি-উত্তর ভারতে সব লেনদেনকেই ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে মোদী সরকার৷ ফলে ব্যবসায়িক লেনদেনের সময় জিএসটি নথিভুক্তি ক্রম, অথবা করদাতার স্থায়ী অ্যাকাউন্ট নম্বর, অর্থাৎ ‘প্যান', কিংবা ব্যক্তিগত পরিচিতির আধার কার্ড নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷
মজুতদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীর জন্যে ক্রেতাদের এই তথ্য নেওয়াটা বাধ্যতামূলক, তার নিজের কেনা-বেচার হিসেব রাখার খাতিরেই৷ কিন্তু ছোট ব্যবসায়ী যাঁরা, নেহাতই কম টাকার লেনদেন করেন, তাঁরা সেই জটিলতার মধ্যে যেতে চাইছেন না৷ এঁদের অনেকেরই জিএসটি নথিভুক্তি, এমনকি প্যান কার্ডও নেই, এতই সামান্য এঁদের ব্যবসার পরিমাণ৷ তার ওপরে হিসেব দাখিলের সরকারি হুকুম মেনে চলতে গিয়ে এঁরা ধনেপ্রাণে মারা পড়বেন৷
আরও একটি সমস্যার কথা বললেন ব্যবসায়ী অনুপম চক্রবর্তী, যাঁর ব্যবসা চা বাগানে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা৷ তিনি বলছেন, সরকারের আজব নিয়ম ১০ দিনের মধ্যে হিসেব দাখিল করে কর জমা দিতে হবে৷ কিন্তু তাঁদের ব্যবসার ক্ষেত্রে, কলকাতার কারখানা থেকে যন্ত্রাংশ সড়কপথে ত্রিপুরা বা আসামের কোনো চা বাগানে পাঠাতে অন্তত ১৫-২০ দিন সময় লাগে৷ তা হলে কী করে তাঁরা ১০ দিনে একটা বাণিজ্যিক লেনদেনের হিসেব দাখিল করবেন? তবে একটা বিষয় অনুপম বলছেন যে, এর ফলে পণ্য পরিবহন জটিলতামুক্ত হবে৷ বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন কর হারের ঝামেলা থাকবে না, পারমিটের সমস্যা থাকবে না৷ অনেক রাজ্যেই যে কারণে আমদানি শুল্ক আদায়ের চেকপোস্টগুলো তুলে দেওয়া শুরু হয়েছে, খবর পেয়েছেন অনুপম৷ কিন্তু তাঁর মতে, মূল সমস্যা অন্যত্র৷
পণ্য বিশেষে কর হার নির্দিষ্ট করে দেওয়ায়, যে জিনিসটা তাঁরা হয়ত ৫ শতাংশ কর হারে কিনতেন, সেটা এখন ১৮ শতাংশ করের আওতায় চলে আসবে৷ এর ফলে সেই জিনিসটার দাম বাড়বে৷ কিন্তু তাঁরা যখন সেই বেশি দামে সেটা বিক্রি করবেন, ক্রেতারা কিন্তু বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে ব্যবসার পরিমাণ কমিয়ে দেবেন৷ ফলে ব্যবসার অঙ্ক কমবে, লাভ কমবে, বাজার দুর্বল হবে৷ অনুপম বলছেন, আলাদা লোক রেখে হিসেব রাখাই হোক, বা ব্যবসার পরিমাণ ও অঙ্ক ঠিক রাখা, বড় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর কোনো অসুবিধে হবে না৷ মারা পড়বে তাঁদের মতো ছোট মাপের ব্যবসায়ীরা৷
জনশ্রুতি অবশ্য আছে, যে নরেন্দ্র মোদী আম্বানিদের রিলায়েন্স, বা আদানির ফিউচার গ্রুপের মতো বড় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীকে যতটা নেকনজরে রাখেন, ছোট, বা মাঝারি ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে ততটা গুরুত্ব পায় না৷ ছোট কিছুতে সম্ভবত বিশ্বাসই রাখেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী৷