1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দুর্বল সরকার ও রাজনীতির কারণে আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি

এম আবুল কালাম আজাদ
এম আবুল কালাম আজাদ
১৪ অক্টোবর ২০২২

বিএনপির শেষ মেয়াদে এক জেলা প্রশাসক চিঠি দিয়ে তার এলাকার সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তলব করা হয়৷ জানতে চাওয়া হয় কীভাবে তিনি একজন এমপির বিরুদ্ধে চিঠি দিতে পারেন?

https://p.dw.com/p/4ICBL
২০১৮ সালের নির্বাচনের একটি দৃশ্য
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকার জন্য আমলারা ক্রেডিট নিতে শুরু করেন৷ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain

জবাবে তিনি বলেছিলেন, একজন ডিসি হিসেবে তার কর্তব্য সরকার তথা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা৷

এই স্বার্থের পরিপন্থি কাজ কেউ করলে ঐ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা ডিসি হিসাবে তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷ ডিসিরা এভাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই কাম্য৷

তবে পরিস্থিতি আর সেরকম নাই৷ এখন তারা মন্ত্রী-এমপিদের প্রটোকল দেয়া এবং সরকারদলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়াকে বড় দায়িত্ব মনে করেন৷ ডিসিরা সরকারি দলের এমপি বা নেতাদের সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ৷ ক্ষেত্র বিশেষে তারা নিজেদের বেশি ক্ষমতাবান মনে করে, যার বহিঃপ্রকাশ ইতিমধ্যেই আমরা অনেকবার দেখেছি৷

প্রশ্ন হলো, কীভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো?

রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসাবে সকল আমলার গুরুদায়িত্ব হলো সরকার ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের কল্যাণে কাজ করা৷ কিন্তু তারা সেটা করেন না, অথবা করতে পারেন না৷ এক্ষেত্রে তারা যত দায়ী তার চেয়েও বেশি দায়ী হলো রাজনীতিবিদরা বা সরকারী দল৷ একদিকে ক্ষমতাশালী দল যেমন তার স্বার্থে আমলাদের ব্যবহার করে, অন্যদিকে আমলারাও এর হিসাব সুদে-আসলে মিটিয়ে নেন৷

সহজভাবে বললে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ডিসিদের, বিশেষ করে নির্বাচনে ব্যবহার করায় তাদের দৌরাত্ম্য অনেক বেড়ে যায়৷ নিজ গন্ডির বাইরে গিয়েও তাদের তাই অনেক কিছু করতে দেখা যাচ্ছে৷ তবে এই হিসাবটা বুঝতে হলে কিছুটা পেছনে ফিরতে হবে৷

একজন রিপোর্টার হিসাবে সচিবালয়ে দেখেছি সচিবরা মন্ত্রীদের সামনে সমীহ করে কথা বলতেন৷ মন্ত্রীরা ছিলেন পরিপক্ব, আবার আমলারাও কাজ করতেন দক্ষতার সাথে৷ ফলে এক ধরনের ভারসাম্য ছিল৷ কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর হতে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে৷ আগে মন্ত্রীরা যে টোনে কথা বলতেন, তা বদলাতে থাকে৷ এমনকি অনেক মন্ত্রীকে দেখা গেছে সচিবের রুমে বসে কথা বলতে, তাদের সাথে বুদ্ধি-পরামর্শ করতে৷

সাধারণত জনপ্রশাসন, বিশেষ করে অ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসারদের কম-বেশি সব সরকারই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে৷ আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে৷ তবে নির্বাচনের আগে আমলাদের, বিশেষ করে ডিসি-এসপিদের কদর বেড়ে যায়৷ ফলে দেখা গেছে, পদ না থাকলেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়৷ দেয়া হয়েছে অন্য সুযোগ-সুবিধা৷

এই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন৷ অভিযোগ ওঠে, জাতীয় নির্বাচনে আমলাদের ভূমিকা পালনের জন্য এটা ছিল আগাম পুরস্কার৷ সে সময় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে সব কাজ করানো যায়৷ ফলে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা একটু বেশি পাবেন, এটাই স্বাভাবিক৷

পরবর্তীতে আমরা দেখেছি কীভাবে ইউএনও এবং ডিসিরা নির্বাচনে কী ভূমিকা রেখেছে৷ এর মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়৷ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকার জন্য আমলারা ক্রেডিট নিতে শুরু করে৷ অনেকে বলতে থাকেন তারাই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছেন৷ আওয়ামী লীগ ও এর নেতারাও তাদের ভূমিকায় খুশি হয়৷ ফলে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়৷

তাই ২০১৮ সালের পর হতে আমলারা নিজেদের অনেক ‘ক্ষমতাসীন’ ভাবতে থাকে৷ তারা বুঝে গেছে, এই সরকার তাদের উপর অনেক নির্ভরশীল৷ ফলে, তারা নিজেদের এখন ক্ষমতার অংশীদার মনে করেন৷ আর এর বহিঃপ্রকাশও আমরা দেখে থাকি প্রায়ই৷

সম্প্রতি ডিসিরা নির্বাচন কমিশনের সাথে এমন আচরণ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছেন, যা তারা কোনোভাবেই পারেন না৷ নির্বাচন কমিশন হচ্ছে এটা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং ডিসি-এসপিরা কমিশনের নির্দেশনা মতো চলতে বাধ্য৷ তবে বেশ কয়েক বছর ধরে তারা যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহিত সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছে এই ঘটনা তারই প্রতিফলন৷

ক্ষমতাসীন দলের সাথে এতটাই সখ্য গড়ে উঠেছে যে, ডিসিরা তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছেন৷ যেমন  ভোট কেন্দ্রের বুথে কেউ প্রবেশ করলে তার রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে ডিসি বা এসপির দায়িত্ব হলো সরাসরি তাকে আটক করা৷ কিন্তু তারা কি তা করছেন? না, করছেন না৷ কারণ, তারা মনে করেন যে, তারা সরকারি দলের অনেক ঘনিষ্ঠ এবং সরকারি দলের লোকজন যা করবে তার প্রতি তাদের সমর্থন থাকতে হবে৷ এটাকে তারা এখন দায়িত্বও মনে করেন৷ এছাড়া সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার একটা উপায়, যা তাদের পদোন্নতি ও ভালো পদ পেতে সাহায্য করে৷ 

এম আবুুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলে
এম আবুুল কালাম আজাদ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কারণে অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আমলারা এখন বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন৷ শুধু তাই না, মন্ত্রী-এমপিরাও এখন ডিসিদের তোষামোদ করে থাকে৷ সরকার প্রধান থেকে শুরু সবাই এখন তাদের উপর অনেক আস্থা রাখছে৷ ফলে, আমলারা এখন যা চায় তার প্রায়ই সবই পেয়ে থাকে৷

বিগত কয়েক বছরে আমলারা একদিকে যেমন ক্ষমতাবান হয়েছেন, অন্যদিকে দুর্বল হয়ে পরেছে রাজনীতিবিদরা৷ ফলে আমলাদের দৌরাত্ম্য সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে৷ এমন অবস্থায় সরকার আগামী দিনে আমলাদের উপর আরো বেশি নির্ভর করবে৷ আর আমলারাও সে সুযোগটা কাজে লাগাবে, যা কারো কাম্য না৷ এটা রাষ্ট্র পরিচালনায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে৷ এই অবস্থা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে৷ 

এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে নির্বাচনে আমলাদের খবরদারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ ২০১৮ সালের মতো বিতর্কিতভাবে তাদের আর নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে না৷ নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতাবলে মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রন করবে৷ ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ডিসি-এসপিরা কাজ করবে৷ এভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠবে৷ ফলে স্বাভাবিক আমলা বা ডিসিদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে এবং শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য তৈরি হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য