জবাবে তিনি বলেছিলেন, একজন ডিসি হিসেবে তার কর্তব্য সরকার তথা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা৷
এই স্বার্থের পরিপন্থি কাজ কেউ করলে ঐ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা ডিসি হিসাবে তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷ ডিসিরা এভাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই কাম্য৷
তবে পরিস্থিতি আর সেরকম নাই৷ এখন তারা মন্ত্রী-এমপিদের প্রটোকল দেয়া এবং সরকারদলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়াকে বড় দায়িত্ব মনে করেন৷ ডিসিরা সরকারি দলের এমপি বা নেতাদের সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ৷ ক্ষেত্র বিশেষে তারা নিজেদের বেশি ক্ষমতাবান মনে করে, যার বহিঃপ্রকাশ ইতিমধ্যেই আমরা অনেকবার দেখেছি৷
প্রশ্ন হলো, কীভাবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো?
রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসাবে সকল আমলার গুরুদায়িত্ব হলো সরকার ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের কল্যাণে কাজ করা৷ কিন্তু তারা সেটা করেন না, অথবা করতে পারেন না৷ এক্ষেত্রে তারা যত দায়ী তার চেয়েও বেশি দায়ী হলো রাজনীতিবিদরা বা সরকারী দল৷ একদিকে ক্ষমতাশালী দল যেমন তার স্বার্থে আমলাদের ব্যবহার করে, অন্যদিকে আমলারাও এর হিসাব সুদে-আসলে মিটিয়ে নেন৷
সহজভাবে বললে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ডিসিদের, বিশেষ করে নির্বাচনে ব্যবহার করায় তাদের দৌরাত্ম্য অনেক বেড়ে যায়৷ নিজ গন্ডির বাইরে গিয়েও তাদের তাই অনেক কিছু করতে দেখা যাচ্ছে৷ তবে এই হিসাবটা বুঝতে হলে কিছুটা পেছনে ফিরতে হবে৷
একজন রিপোর্টার হিসাবে সচিবালয়ে দেখেছি সচিবরা মন্ত্রীদের সামনে সমীহ করে কথা বলতেন৷ মন্ত্রীরা ছিলেন পরিপক্ব, আবার আমলারাও কাজ করতেন দক্ষতার সাথে৷ ফলে এক ধরনের ভারসাম্য ছিল৷ কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর হতে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে৷ আগে মন্ত্রীরা যে টোনে কথা বলতেন, তা বদলাতে থাকে৷ এমনকি অনেক মন্ত্রীকে দেখা গেছে সচিবের রুমে বসে কথা বলতে, তাদের সাথে বুদ্ধি-পরামর্শ করতে৷
সাধারণত জনপ্রশাসন, বিশেষ করে অ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসারদের কম-বেশি সব সরকারই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে৷ আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে৷ তবে নির্বাচনের আগে আমলাদের, বিশেষ করে ডিসি-এসপিদের কদর বেড়ে যায়৷ ফলে দেখা গেছে, পদ না থাকলেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়৷ দেয়া হয়েছে অন্য সুযোগ-সুবিধা৷
এই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন৷ অভিযোগ ওঠে, জাতীয় নির্বাচনে আমলাদের ভূমিকা পালনের জন্য এটা ছিল আগাম পুরস্কার৷ সে সময় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে সব কাজ করানো যায়৷ ফলে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা একটু বেশি পাবেন, এটাই স্বাভাবিক৷
পরবর্তীতে আমরা দেখেছি কীভাবে ইউএনও এবং ডিসিরা নির্বাচনে কী ভূমিকা রেখেছে৷ এর মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়৷ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকার জন্য আমলারা ক্রেডিট নিতে শুরু করে৷ অনেকে বলতে থাকেন তারাই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছেন৷ আওয়ামী লীগ ও এর নেতারাও তাদের ভূমিকায় খুশি হয়৷ ফলে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়৷
তাই ২০১৮ সালের পর হতে আমলারা নিজেদের অনেক ‘ক্ষমতাসীন’ ভাবতে থাকে৷ তারা বুঝে গেছে, এই সরকার তাদের উপর অনেক নির্ভরশীল৷ ফলে, তারা নিজেদের এখন ক্ষমতার অংশীদার মনে করেন৷ আর এর বহিঃপ্রকাশও আমরা দেখে থাকি প্রায়ই৷
সম্প্রতি ডিসিরা নির্বাচন কমিশনের সাথে এমন আচরণ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছেন, যা তারা কোনোভাবেই পারেন না৷ নির্বাচন কমিশন হচ্ছে এটা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং ডিসি-এসপিরা কমিশনের নির্দেশনা মতো চলতে বাধ্য৷ তবে বেশ কয়েক বছর ধরে তারা যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহিত সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েছে এই ঘটনা তারই প্রতিফলন৷
ক্ষমতাসীন দলের সাথে এতটাই সখ্য গড়ে উঠেছে যে, ডিসিরা তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছেন৷ যেমন ভোট কেন্দ্রের বুথে কেউ প্রবেশ করলে তার রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে ডিসি বা এসপির দায়িত্ব হলো সরাসরি তাকে আটক করা৷ কিন্তু তারা কি তা করছেন? না, করছেন না৷ কারণ, তারা মনে করেন যে, তারা সরকারি দলের অনেক ঘনিষ্ঠ এবং সরকারি দলের লোকজন যা করবে তার প্রতি তাদের সমর্থন থাকতে হবে৷ এটাকে তারা এখন দায়িত্বও মনে করেন৷ এছাড়া সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার একটা উপায়, যা তাদের পদোন্নতি ও ভালো পদ পেতে সাহায্য করে৷
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কারণে অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আমলারা এখন বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন৷ শুধু তাই না, মন্ত্রী-এমপিরাও এখন ডিসিদের তোষামোদ করে থাকে৷ সরকার প্রধান থেকে শুরু সবাই এখন তাদের উপর অনেক আস্থা রাখছে৷ ফলে, আমলারা এখন যা চায় তার প্রায়ই সবই পেয়ে থাকে৷
বিগত কয়েক বছরে আমলারা একদিকে যেমন ক্ষমতাবান হয়েছেন, অন্যদিকে দুর্বল হয়ে পরেছে রাজনীতিবিদরা৷ ফলে আমলাদের দৌরাত্ম্য সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে৷ এমন অবস্থায় সরকার আগামী দিনে আমলাদের উপর আরো বেশি নির্ভর করবে৷ আর আমলারাও সে সুযোগটা কাজে লাগাবে, যা কারো কাম্য না৷ এটা রাষ্ট্র পরিচালনায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে৷ এই অবস্থা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে৷
এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে নির্বাচনে আমলাদের খবরদারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ ২০১৮ সালের মতো বিতর্কিতভাবে তাদের আর নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে না৷ নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতাবলে মাঠ প্রশাসন নিয়ন্ত্রন করবে৷ ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ডিসি-এসপিরা কাজ করবে৷ এভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠবে৷ ফলে স্বাভাবিক আমলা বা ডিসিদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে এবং শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্য তৈরি হবে৷