জার্মানিতে শিশুদের অবস্থা
২০ জানুয়ারি ২০১৬নয়ত জার্মানিতে স্কুলের মাস্টাররা এককালে বেত হাতে করেই ক্লাসে ঢুকতেন৷ বাড়িতে দুষ্টু ছেলেদের শাসনের পদ্ধতিও কিছু আলাদা ছিল না৷ কিন্তু নাৎসি আমলের দুঃস্বপ্নের পর যে নতুন গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল জার্মানি সৃষ্টি হয়, সেখানে আদর্শ থেকে আইনের দূরত্ব অনেক ছোট হয়ে আসে৷ আরো বড় কথা, মানুষজন সেটাকে মেনে নিয়ে নিজেদের বদলাতে শেখেন৷ অর্থাৎ আগে আইন বদলে, পরে মানুষ বদলানো৷ না, ঘটনাটা ঘটেছিল অন্যভাবে৷
স্কুলে শারীরিক দণ্ডদানের বিরুদ্ধে নিরুচ্চার থেকে সোচ্চার প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে বিশেষ করে সত্তরের দশকে, তথাকথিত আটষট্টির প্রজন্মের আধা-হিপি জার্মানরা যখন যাবতীয় কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা ও আচার-আচরণ প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেন৷ সেই ঢেউ গিয়ে থামে ১৯৮৩ সালে, যখন স্কুলে শারীরিক শাস্তি বর্জন করা হয়৷ শিক্ষকদের জন্য সে ধরনের শারীরিক দণ্ডদান দায়রা অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় তারও দশ বছর পরে, ১৯৯৩ সালে৷ বাড়িতে মারধোরের সমস্যাটা কিন্তু তখনও রয়েই গিয়েছে৷
শিক্ষকের পরে বাবা-মা
২০০০ সালে জার্মান সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেন, যে আইনে বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক দণ্ডদান নিষিদ্ধ করা হয়৷ জার্মান সিভিল কোড-এর ১৬৩১ ধারা সংশোধন করে দাঁড়ায়: ‘‘শিশুদের অহিংসভাবে প্রতিপালিত হবার অধিকার আছে৷ শারীরিক দণ্ডদান, মানসিক আঘাত বা অপরাপর অবমাননাকর পদক্ষেপ অনুমতিযোগ্য নয়৷''
এ তো গেল আইন৷ কিন্তু সেই আইনকে বাস্তবের সঙ্গে মেলানোর একটি ভালো দৃষ্টান্ত ছিল জার্মান সরকারের সামনে: সুইডেন, যারা ১৯৭৯ সালেই ছোটদের শারীরিক দণ্ডদান সংক্রান্ত আইন সংশোধন করেছিল৷ সুইডেনের দেখাদেখি জার্মান সরকারও আইনের সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ গণসচেতনতা বৃদ্ধি অভিযান শুরু করেন৷ সে অভিযানের দায়িত্ব ছিল পরিবার মন্ত্রণালয়ের হাতে – তা-তে যোগ দিয়েছিল বহু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং বিশেষজ্ঞরা৷ অভিযানের লক্ষ্য ছিল, বাবা-মায়েদের শারীরিক দণ্ডদানের কুফল সম্পর্কে অবহিত করা এবং অহিংস, ইতিবাচক অভিভাবকত্বের পন্থা প্রদর্শন করা৷
আইন প্রণয়নের বছর দুয়েকের মধ্যেই একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সেই আইন শিশুদের শারীরিক দণ্ডদানের আইনগত বাধাবিপত্তি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছে; শারীরিক দণ্ডদান যে এক ধরনের সহিংসতা, সে বিষয়ে চেতনা বাড়িয়েছে; এবং শারীরিক নিপীড়ন না করে শিশুদের অন্য কি ধরনের সাজা বা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে পারিবারিক আঙ্গিকে আলাপ-আলোচনা ও তর্কাতর্কি বাড়িয়েছে! অর্থাৎ আইন প্রণয়নের মতো একটি শুকনো ঘটনা জনতার মনোভাব ও আচরণ প্রভাবিত করতে সক্ষম, যদি প্রচারণা ও গণশিক্ষামূলক অপরাপর কর্মসূচি তার সঙ্গে যুক্ত হয়৷
কাজেই ২০০৯ সালে জার্মানির তৎকালীন পরিবারমন্ত্রী উর্সুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনকে সগর্বে ঘোষণা করতে শোনা গেছে, ‘‘শিশুদের উপর সহিংসতা আজ অতীতের ঘটনা৷ আজ আর প্রায় কোথাও শারীরিক দণ্ডদানের বিধি নেই৷'' এককালে জার্মান অভিভাবকরা তাদের কড়া শাসনের জন্য সুবিদিত ছিলেন, আজ তা পুরোপুরি বদলে গেছে – বলেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে: জার্মান বাবা-মায়েরা আজকাল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আচার-আচরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন৷ তার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, কঠোর সময়ানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলার মতো আদি জার্মান গুণাগুণগুলির কদরও অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে৷
প্রিয় পাঠক, জার্মানির মতো আমরাও কি সন্তানকে না পিটিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে তার আচরণে পরিবর্তন আনতে পারিনা? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে...