নির্যাতিত শৈশব, বিপন্ন শিক্ষা
২৮ জুলাই ২০১৪সারা কলকাতা শহরই নয়, গোটা রাজ্য, দেশ চমকে উঠেছে দৃশ্যটা দেখে৷ ঘটনাটি এই রকম, কলকাতার লেকটাউন-দক্ষিণদাঁড়ি এলাকার এক পরিবার, তাদের তিনবছরের শিশুপুত্রের জন্য নতুন একজন গৃহশিক্ষিকা নিযুক্ত করেছিল৷ ওই বয়সি অধিকাংশ শিশুর মতো এই বাচ্চাটিও প্রথম দুদিন নতুন দিদিমনির কাছে পড়তে বসতে চায়নি৷ তৃতীয় দিনে ওই গৃহশিক্ষিকা এসে বাচ্চাটির মা-কে বলে ঘরের বাইরে যেতে৷ সম্ভবত তাঁকে সামনে দেখেই বাচ্চাটি বেশি বায়না করছে ভেবে মা-ও চলে যান বাইরের ঘরে৷ এরপর দরজা বন্ধ করে শিশুটিকে সহবৎ শেখানোর দায়িত্ব হাতে নেন ওই শিক্ষিকা৷
ছেলের কান্না প্রথমেই কানে এসেছিল মায়ের৷ তিনি ভেবেছিলেন হয়ত একটু বকাবকি, খুব বেশি হলে হালকা একটু চড়-চাপড় খাচ্ছে ছেলে৷ কিন্তু কান্নার আওয়াজ ক্রমশ তীব্র হতে উদ্বিগ্ন মা ঘরে লাগানো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাটি চালিয়ে যা দেখতে পান, তাতে ভয়ে তাঁর হাড় হিম হয়ে যায়৷ বন্ধ ঘরের মধ্যে ওই শিক্ষিকা তাঁর শিশুপুত্রকে চ্যাংদোলা করে এনে আছাড় মারছে বিছানার ওপর! এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রেখে অন্য হাতে বেদম চড়, কিল, ঘুসি মারছে! এবং একবার নয়, পর পর দুবার পা তুলে ওইটুকু ছেলের বুকে লাথি কষাচ্ছে!
ঘটনাটি যাতে পুলিশে না জানানো হয়, সে জন্য বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল ওই গৃহশিক্ষিকার স্বামী৷ কিন্তু তার পরেও পুলিশে অভিযোগ জানানো হয়, যার পর ফেরার হয়ে যায় ওই গৃহশিক্ষিকা৷ অন্ধ্রের এক দৃষ্টিহীন স্কুলে শিক্ষকের হাতে এক ছাত্রের বেদম মার খাওয়ার দৃশ্যের টিভি ফুটেজ সারা দেশের সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর কলকাতা শহরের এই ঘটনা ফের উদ্বেগ, উত্তেজনা ছড়িয়েছে সমাজে৷ স্কুলে বেত পেটা করা বা অন্যান্য শারীরিক শাস্তি দেওয়ার ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে অনেক আগেই এবং বহু স্কুল এখন সেই নিয়ম মেনে চলে৷ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ছাত্র বা ছাত্রীর অভিভাবকদের ডেকে পাঠায় স্কুল, শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিজেরা হাতে নেয় না৷ কিন্তু গৃহশিক্ষকের ক্ষেত্রে এমন নির্মম, অমানবিক আচরণ নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে প্রশাসনকে৷
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গৃহশিক্ষক এবং অভিভাবকদেরও সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার শুরু করার৷ অন্যদিকে পুলিশ জানিয়েছে, এখন থেকে গৃহশিক্ষক নিয়োগের সময়ও বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে আগাম জানিয়ে রাখতে হবে পুলিশকে৷ তার একটা কারণ যদিও লেকটাউনের ওই গৃহশিক্ষিকা তাঁর ছাত্রের বাড়িতে নিজের ঠিকানা-সহ যা তথ্য দিয়েছিল, সবই ভুয়ো বলে ঘটনার তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে পুলিশ৷
ফলে বাড়িতে কাজের লোক, ড্রাইভার রাখার ক্ষেত্রে যা নিয়ম এতদিন চালু ছিল, এবার গৃহশিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সেই একই বিধিনিষেধ চালু করতে চায় পুলিশ৷ তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষা হয়ত নিশ্চিত হবে, কিন্তু গৃহশিক্ষকদের যে সম্মানহানি হবে, তা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু পুলিশও এ ক্ষেত্রে নিরুপায়৷ আর তার থেকেও বড় কথা, ওই গৃহশিক্ষিকা কী শিখিয়ে গেলেন সমাজকে! এটাই কি, যে বাবা-মায়ের পরেই জীবনে যে শিক্ষকদের স্থান ছিল, তাঁদের ওপরেও আর ভরসা রাখা যাচ্ছে না?
দীর্ঘদিন শিক্ষকতার কাজ করছেন অভিজিৎ ব্যানার্জি৷ কোনও স্কুলে নয়, তিনিও নিজের বাড়িতে দুবেলা ক্লাস নেন৷ তিনি স্বীকার করলেন যে গৃহশিক্ষকদের মান বেশ কিছু বছর ধরে ক্রমশই অধোগামী৷ তার সবথেকে বড় কারণ, শিক্ষকতা আজকাল নেহাতই একটা পেশা৷ কোনও মহতি ভাবনা থেকে আজকাল আর কেউ শিক্ষকতা করতে আসেন না৷ সেই সব শিক্ষকরাও আর নেই, যাঁদের দেখে ভবিষ্যৎ গঠনের কর্তব্যবোধ পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্যে সঞ্চারিত হবে৷ অন্যদিকে এক অভিভাবকের বক্তব্য, বর্তমান শিক্ষকরাই সেই সম্মান আদায়ে ব্যর্থ! এঁরা ঘড়ি ধরে পড়ান, গুণে পয়সা নেন এবং আর পাঁচটা চাকরির মতো সবেতন ছুটি-সহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দাবি করেন!
তবে সাম্প্রতিক এই শিশু নিগ্রহের ঘটনাটি যে শুধু ধিক্কারযোগ্য, তা নয়, এমন ঘটনা যে ঘটাই উচিত হয়নি, এ ব্যাপারে শিক্ষক থেকে অভিভাবক, সবাই একমত৷ কিন্তু সমস্যা হল, দায়িত্বশীল, স্নেহপ্রবণ শিক্ষকের যেখানে আকাল, সেখানে এমন অযোগ্য মানুষের হাতে সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার বাধ্যতা থেকেই বা নিষ্কৃতি মিলবে কীভাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা৷