কেমন করে ভিয়েতনাম জিতছে করোনা ‘যুদ্ধ’?
২৯ মার্চ ২০২০করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীন থেকে শুরু হয়ে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে ছড়িয়ে গেছে৷ অথচ ভিয়েতনামে তেমন কিছু হয়নি৷
শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আক্রান্ত হয়েছেন সোয়া নয় লাখের বেশি৷ মারা গেছেন ৫৩ হাজার নয়শোর উপরে৷ অথচ চীনের সঙ্গে ১১০০ কিলোমিটার সীমান্ত থাকার পরও ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে মাত্র ২৭০জন আক্রান্ত হয়েছেন৷ এর মধ্যে ২২৫ জনই সুস্থ হয়েছেন৷ এখন পর্যন্ত মারা যাননি কেউ৷
এর অর্থ করোনা মোকাবেলায় ভিয়েতনাম বেশ ভালো করছে৷
গত জানুয়ারির শেষে টেট নববর্ষ উদযাপনের সময় ভিয়েতনামের সরকার করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, যদিও প্রাদুর্ভাব তখনো চীনেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রী এনগুয়েন জুয়ান ফুক বলেন, খুব দ্রুতই এই ভাইরাস এখানে এসে পড়বে৷ ‘‘এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা,’’ বলেন ফুক৷
সর্বাত্মক ব্যবস্থা
বিষয় হলো, ব্যবস্থা নিতে হলে দু'টো জায়গায় ভরসা রাখতে হবে৷ এক হলো সরকারের অর্থ, আর দুই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যে দু'টিতেই ঘাটতি আছে ভিয়েতনামের৷
দক্ষিণ কোরিয়ার মতো লাখ লাখ পরীক্ষা করার সাধ্য নেই তাদের৷ হো চি মিন শহরের মেয়র জানিয়েছেন, তাঁর শহরের ৮০ লাখ লোকের জন্য ইনটেন্সিভ কেয়ার বেড আছে মাত্র নয়শ'টি৷ এ শহরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সহজেই তা সামর্থ্যকে অতিক্রম করবে৷
তাই করোনা মোকাবেলায় ভিয়েতনাম কড়াকড়িভাবে কোয়ারেন্টিন নীতি গ্রহণ করে৷ যারা এই ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে খুঁজে বের করে৷ চীন সম্পূর্ণ লকডাউন করার আগেই তারা এ কাজগুলো করে৷
যেমন, ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন সপ্তাহের জন্য হ্যানয়ের পাশে ১০ হাজার অধিবাসীর একটি শহর সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে তারা৷ সে সময় পুরো দেশে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ১০ জন৷
জার্মানির মতো পশ্চিমা দেশগুলোও যেখানে আক্রান্ত ও তাদের সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে এমন লোকদের খুঁজে বের করছে, সেখানে ভিয়েতনাম আক্রান্তদের সরাসরি, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের সংস্পর্শে আসা মানুষদেরও খোঁজ রেখেছে৷ এদের সবার ওপর চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷
আর একেবারে শুরু থেকেই উচ্চ ঝুঁকি এলাকাগুলো থেকে যারাই ভিয়েতনামে এসেছেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে৷ ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ রাখা হয়েছে৷
ভিয়েতনামের নজরদারির অবস্থা
শুধু ঔষধ ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তির সহায়তায় করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর চেষ্টার পরিবর্তে ভিয়েতনাম তাদের সবার আস্থার সেনাবাহিনীর উচ্চমানের প্রযুক্তির নজরদারি সেবাটি কাজে লাগিয়েছে৷
নিরাপত্তা কর্মকর্তা বা কমিউনিস্ট পার্টির গোয়েন্দাদের প্রত্যেক সড়ক ও ক্রসিংয়ে অথবা প্রত্যেক গ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে৷ মিলিটারিও তাদের সদস্য ও যন্ত্রপাতি নিয়ে মাঠে যাচ্ছে৷
নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে নিয়ম না মানা খুব দুঃসাধ্য সেখানে৷
তবে সমস্যা হলো, কোভিড-১৯ আক্রান্তরা সমাজে ও সামাজিক গণমাধ্যমে একঘরে হয়ে পড়েছেন৷ যেমন, এক নারী ইউরোপ থেকে ভাইরাস হ্যানয় শহরে নিয়ে গেছেন বলে চাউর হয়ে গেছে৷ তিনি কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন না হওয়ায় কিংবা কোয়ারেন্টিনে না থাকায় তাকে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক হেনস্থা করা হয়েছে৷
এই নারীর ঘটনাটি ভিন্ন৷ তিনি যখন ভিয়েতনামে ফেরেন, তখন প্রথম ১৬ জন যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, সবাই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন৷ তাই তিনি ভাইরাসটি আবার নিয়ে এসেছেন এমনটিই সাধারণের ধারণা৷
সামাজিকভাবে এমন একঘরে হয়ে যাবার ভয়ে অনেকেই অসুস্থ হলেই কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হচ্ছেন৷
যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা
ভিয়েতনাম করোনা পরিস্থিতিকে যুদ্ধের সঙ্গে অলঙ্করণ করছে৷ যেমন, প্রধানমন্ত্রী ফুক বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক ব্যবসা, প্রত্যেক নাগরিক, প্রত্যেক আবাসিক এলাকা এই প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে একেকটি দূর্গ৷’’
এই তুলনা অনেক ভিয়েতনামিজের মধ্যে এক রকমের আবেগ তৈরি করেছে৷ তারা একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো ও ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিতে গিয়ে গর্ববোধ করছেন৷
রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম ব্যাপক হারে তথ্য প্রচার করছে৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাত ধোয়ার ওপর একটি ভিডিও ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছে, যা ভাইরাল হয়ে গেছে৷
নিয়ম মানা
যদিও কোনো জরিপ করা হয়নি, তবে সামাজিক গণমাধ্যম ও ভিয়েতনামিজদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় যে, তারা সরকারের উদ্যোগগুলোর সঙ্গে একমত৷
ভিয়েতনাম অনেকের চেয়ে সংকট মোকাবেলা ভালোভাবে করছে বলে তারা গর্ববোধ করেন৷ দেশের সবচেয়ে বড় করোনাযোদ্ধা হিসেবে এরই মধ্যে ফেসবুকে ‘জাতীয় বীর' খ্যাতি পেয়ে গেছেন সহপ্রধানমন্ত্রী ভু দুক দাম৷
তবে কিছু মানুষ ভিয়েতনামের এক দলীয় কমিউনিস্ট সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে বলে বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না৷ তাদের অভিযোগ সরকার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেন৷
এদিকে, মিডিয়ার ওপর সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণও মেনে নিয়েছেন মানুষ৷ এমনকি আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও যে বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে যাচ্ছে, তা-ও মেনে নিয়েছে জনগণ৷
সরকারের হিসেবে ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে তিন হাজার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে৷ ভিনগ্রুপের মতো বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পর্যটকের অভাবে তাদের অনেকগুলো হোটেল ও রিসোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে৷ এতে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছেন৷
এই বাড়তি চাপ সামলাতে ভিয়েতনাম সরকার প্রায় ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ বরাদ্দ রেখেছে৷ তবে ধারণা করা হচ্ছে, সংকটের কারণে কর আদায় অনেক কমে যাবে৷ সরকার জনগণের কাছে অর্থ চেয়েছে৷ তারাও যে যার মতো দিচ্ছেন৷ তারা মনে করেন, এভাবেই সম্ভব করোনা ভাইরাস মোকাবিলা৷
রডিয়ন এবিগহাউজেন/জেডএ