সুইডেন পারলে, ভারত পারবে না কেন
১৩ এপ্রিল ২০২০করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে লকডাউনই কি একমাত্র পথ? প্রশ্নটি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বার বার সামনে আসছে। ভারতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, লকডাউনে মার খাচ্ছে অর্থনীতি। কাজ হারাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ। কার্যত অভুক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের গরিব শ্রমিকরা। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই তুলনা টানছেন সুইডেনের। সুইডেন করোনা আক্রান্ত দেশ, তা সত্ত্বেও সেখানে লকডাউন হয়নি। কার্যত একটি নতুন মডেল তৈরি করেছে সেখানকার সরকার। ভারতীয় উপমহাদেশ কি তা অনুসরণ করতে পারে?
আলোচনায় ঢোকার আগে একবার পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। সুইডেনের মোট জনসংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ। সোমবার পর্যন্ত সেখানে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মানুষ। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৯০০ জনের। অন্য দিকে, ১৩৭ কোটির ভারতে এখনও পর্যন্ত আক্রান্তহয়েছেন নয় হাজার ২০০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৩১ জনের। সংখ্যাতত্ত্বের সাধারণ হিসেবেই ভারতের চেয়ে সুইডেন অনেক বেশি সংকটে। কিন্তু ভারতের মতো সুইডেন সরকার সম্পূর্ণ লকডাউনের পথে হাঁটেনি। এখনও সেখানে জীবনযাত্রা মোটের ওপর স্বাভাবিক। উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজ বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা। সরকারের বক্তব্য, সেখানে যথেষ্ট সচেতন ভাবেই ছোটদের পড়ানো হচ্ছে। প্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দিলে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কমে যাবে। অনেকেই ছুটি নিয়ে বাড়িতে বাচ্চা সামলাবেন। রেস্তোরাঁ, পাব, বার, পার্কও খোলা। যদিও সরকার জানিয়েছে, রেস্তোরাঁয় একমাত্র টেবিলে বসেই খাওয়া দাওয়া করা যাবে। এক জায়গায় অনেকে দাঁড়িয়ে ভিড় করে খেতে পারবেন না। ৫০ জনের বেশি সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও সামাজিক দূরত্বের কড়া আইন তৈরি করা হয়নি। সরকার বার বার জানাচ্ছে, বয়স্ক এবং অসুস্থ ব্যক্তিরা যেন বাড়িতে আইসোলেশনে থাকেন। কিন্তু যুবক এবং তরুণদের বাইরে বেরনোর ক্ষেত্রে তেমন কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়নি। খোলা অফিস, কাছারি। তবে ছোট অফিসগুলিকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করতে বলতে। সুইডেনের বক্তব্য, করোনার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে অর্থনীতি ধসে গেলে তাতে মানুষ আরও বিপদে পড়বেন। বস্তুত, করোনা সংকটে সুইডেন যে ভাবে চলছে, অনেকেই তাকে একটি মডেল হিসেবে দেখছেন। বিতর্কও হচ্ছে। কারও মতে এ ভাবে চলার কারণে গত কয়েক সপ্তাহে সুইডেনে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, অর্থনীতি এবং করোনার সঙ্গে লড়াই-- দুইয়ের মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য তৈরি করেছে সুইডেন। অন্য দেশগুলি তার থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
ভারত কি সত্যি সত্যি সুইডেন থেকে শিক্ষা নিতে পারে? এ প্রশ্ন উঠছে কারণ, ২১ দিন লকডাউন ঘোষণা করেও ভারতে সংক্রমণ একেবারে কমিয়ে ফেলা যায়নি। বস্তুত, গত চার দিনে ভারতে সংক্রমণ চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। অন্য দিকে, লকডাউনের প্রভাবে কাজ হারিয়েছেন বা হারাতে বসেছেন প্রায় ১২ কোটি মানুষ। অর্থনীতি প্রবল সংকটে। এতটাই যে, লকডাউন আরও দুই সপ্তাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা হলেও উৎপাদন ক্ষেত্রে ছাড়ের কথা ভাবনা চিন্তা করা হচ্ছে। কারখানা, খাদ্য উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রগুলি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকলে অর্থনৈতিক সংকট যে তীব্র হবে, তা বুঝতে পারছে সরকার। এর মধ্যেই খাবারের অভাবে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটতে শুরু করেছে। বহু জায়গায় বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সিপিএম এর পলিটব্যুরো সদস্য এবং প্রাক্তন সাসংদ মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ''সুইডেন জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র। মানুষের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা সেখানে আছে। ভারত বহুদিন আগেই সে পথ থেকে সরে এসেছে। যে ভাবে চার ঘণ্টার নোটিসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছেন, তা অকল্পনীয়। সাধারণ মানুষের কী ভাবে চলবে, পরিযায়ী শ্রমিকদের কী হবে, সে সব কথা ভাবাই হয়নি। ভাবা হয়নি অর্থনীতির কথাও। একে হঠকারী সিদ্ধান্ত বললেও কম বলা হয়। লকডাউনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা গোটা দেশ জুড়ে নয়, সংক্রমণের মাত্রা বিচার করে তা ঠিক করা উচিত ছিল। এবং একই সঙ্গে অর্থনীতি সচল রাখা প্রয়োজন ছিল। এ দেশে তার কিছুই হয়নি। মাত্র তিন সপ্তাহেই তার ফল ভুগতে শুরু করেছেন দেশবাসী।''
তা হলে কি সুইডেন-মডেল গ্রহণযোগ্য? বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, সুইডেনের মডেলেই এগোচ্ছিল যুক্তরাজ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে লকডাউনের পথে হাঁটেননি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কিন্তু তাতে সংক্রমণ বেড়েছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার পরে সেখানে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা হয়েছে। অ্যামেরিকা একই ভুল করেছে বলে তাঁদের দাবি। আবার এর উল্টো যুক্তিও আছে। তাঁদের বক্তব্য, করোনা ভাইরাস বিষয়ে বিশদ তথ্য এখনও জানা যায়নি। লকডাউন করলেই যে এর সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব, এমন কথা বলা যায় না। যদি তা হতো, তা হলে যে দেশগুলি আগে থেকেইলকডাউনকরেছিল, সেখানে করোনার সংক্রমণ ছড়াতো না। বাস্তবে তা হয়নি। সংক্রমণ কমানো গেলেও বন্ধ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সুইডেন অত্যন্ত বুদ্ধি করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা বহু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও, জীবনযাত্রা একেবারে স্তব্ধ করে দেয়নি। তাতে সংক্রমণ হচ্ছে, মৃত্যুও হচ্ছে, কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি পুরোপুরি ধসে পড়েনি। মৃত্যু যে কোনও রোগেই হতে পারে। সেই ভাবনাটিকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। এবং এখনও পর্যন্ত তারা তার ফলও পাচ্ছে। বস্তুত, গত সপ্তাহেই একটি সংস্থার করা গণভোটে সুইডেনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সরকারের পদক্ষেপের পক্ষে মত দিয়েছেন।
প্রশ্ন হলো, ভারত বা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দেশগুলিতে সুইডেন মডেল গ্রহণযোগ্য কি? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''সুইডেনের জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৫। সেখানে ভারতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন ৪৬৪ জন। ফলে বয়স্কদের আইসোলেশনে রেখেও সুইডেন যে ভাবে তরুণ এবং যুবকদের জীবনযাপন স্বাভাবিক রাখতে পারে, ভারতে তা সম্ভব নয়। স্ক্যানডেনেভিয়ার দেশ গুলিতে মানুষ এতই কম যে সেখানে এমনিতেই সামাজিক দূরত্ব রক্ষিত হয়। কিন্তু ভারতে জনঘনত্বের কারণেই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। ফলে লকডাউন ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।'' ওই আধিকারিকের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব বলছে, লকডাউন না হলে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ভারতে আট লাখ লোক আক্রান্ত হতে পারতেন। লকডাউন হয়েছে বলে সংখ্যাটি ১০ হাজারের মধ্যে আটকে রাখা গিয়েছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আধিকারিক অমিতাভ রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''সুইডেনের সঙ্গে ভারতের কোনও তুলনাই চলে না। দেশের আয়তন, জনঘনত্ব, মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং সচেতনতা সব দিক দিয়েই দু'টি দেশের অনেক তফাত। ফলে সুইডেন যা করতে পারে, ভারত তা কখনওই করতে পারে না।''
তবে লকডাউনের ফলে অর্থনীতি যে বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা মেনে নিচ্ছে সরকারও। মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীও সে কথা স্বীকার করেছেন। এবং সে কারণেই লকডাউন বৃদ্ধির কথা ভাবলেও, উৎপাদন চালু করার মরিয়া চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে জীবনযাত্রাও এ ভাবে স্তব্ধ করে রাখা যায় না। ফলে আজ না হোক কাল সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। যে সমস্ত জায়গায় সংক্রমণ বেশি সেই জায়গাগুলিকে সিল করে বাকি ক্ষেত্রে জীবনযাত্রা ক্রমশ স্বাভাবিক করতেই হবে।