1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠায় পথ দেখাতে হবে বাংলাদেশকে

সঞ্জীব দ্রং
২৬ জুন ২০১৭

মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’ উপন্যাসে ব্রিটিশ আমলের এক মুন্ডা হেডম্যান পহানকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘‘তুই যদি ভালো গোরমেন (গভর্নমেন্ট), তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?’’

https://p.dw.com/p/2fJlo
Bangladesch   Jhum Kultur
ছবি: DW/M. Mamun

জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই মুন্ডা আদিবাসী বুঝেছিলেন, ইংরেজ মানেই শাসক  আর তাঁরা ভালো নয়৷

সেই সময় বিহার রাজ্যের ছোটলাট রোনাল্ডসনের ভাই মুন্ডাদের গ্রামে বেড়াতে এসে আদিবাসীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছিলেন৷ তখন তাঁকে এই কথা বলেছিলেন পহান৷

ব্রিটিশ চলে গেল, পাকিস্তানি শাসক নেই, এখন ৪৬ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ৷ আজ এত বছর পর আপনাদের সামনে আমি সাধারণ একজন (আদিবাসী?) মানুষ এই প্রশ্ন রাখলাম, ‘‘তুই যদি ভালো গোরমেন, তবে আমাদের এত কষ্ট কেন?''

আধুনিকতার দীর্ঘ সময়ে আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব জগত, বসতভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার হারিয়েছে৷ যে পাহাড় ও বনকে তাঁরা স্বতঃসিদ্ধ বলে তাদের ঐতিহ্যগত অধিকার হিসেবে দেখতো, আধুনিক রাষ্ট্র তাঁদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা না করে, সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করেছে৷

টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি জাতীয় উদ্যান গড়ে তুলেছিল ষাটের দশকে আদিবাসী গারোদের ভূমিতে, ওদের উচ্ছেদ করে৷ কাগজে-কলমে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ছিল বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন৷ ভেতরে উদ্দেশ্য ছিল– ভিন্ন আদিবাসী উচ্ছেদ৷ 

আজ এ জাতীয় উদ্যান নির্মাণের ষাট বছর পর আমরা দেখতে পাই, মধুপুর বনের প্রাকৃতিক বৃক্ষ উজাড় হয়ে গেছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রায়, অরণ্য বিরানভূমিতে পরিণত৷ আর বনের আদি অধিবাসী গারো ও কোচদের জীবন মুমূর্ষু৷ বনবিভাগ শত শত নয়, হাজার হাজার মামলা দিয়ে বনের আদি বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে৷ সব কিছুই হয়েছে উন্নয়নের নামে৷ এসব প্রকল্পের ফলে স্থানীয় মানুষের উন্নয়ন হয়নি দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনা বৃদ্ধি ছাড়া৷ অন্যদিকে বাইরে থেকে শত শত মানুষ ঢুকে গেছে একদা আদিবাসী পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় ও বনে৷

আদিবাসীরা নিজভূমিতেই হয়ে গেছে সংখ্যালঘু৷ মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদপ্রিয় লোকদের বনভোজন ও আনন্দভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা, আদিবাসীদের জন্য অযোগ্য৷

এভাবেই উন্নয়নের রাষ্ট্র আদিবাসীদের নিপীড়ন ও ভূমি হারানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দেয়৷ মধুপুর বনে এখন বাসে-ট্রাকে-জিপে করে মানুষ পিকনিক করতে যায়৷ মাইক বাজে৷ বনের পরিবেশ বিপন্ন, মানুষেরাও বিপন্ন৷

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও, ভূমি কমিশন গঠনের ১৫ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন কার্যকর হয়নি৷ অন্যদিকে চুক্তির পরও পাহাড়ে হাজার হাজার একর জমি দখল হয়ে গেছে৷ রিজার্ভ ফরেস্ট, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হর্টিকালচার ও রাবার চাষের নামে ইজারা প্রদান করে হাজার হাজার একর জুম্মদের সামাজিক মালিকানাধীন জুমভূমি ও মৌজাভূমি জবরদখল করা হচ্ছে৷

অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত আদিবাসী শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও পুনর্বাসন হয়নি৷ সব মিলিয়ে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পড়ে আছে৷

রাঙ্গামাটি লেক এখন নাটক ও টেলিফিল্ম নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্পট আর পাহাড়িদের জন্য দুঃখভূমি৷ তাই উন্নয়নকে আদিবাসীরা ভয় পায়৷

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ রেকটিফাই করেন৷ এতে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক, যে জমি ঐতিহ্যগতভাবে ওঁরা ব্যবহার করে, সে জমি তাঁদের৷

কিন্তু এর আলোকে জাতীয় পর্যায়ে আইন বা নীতিমালা হয়নি এখনো৷ বঙ্গবন্ধু রেকটিফাই করে গেছেন৷ বাকিরা পরের কাজগুলো করেননি৷ আইএলও কনভেনশনের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে৷'' আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং এ সবের আলোকে আইন না থাকায় আদিবাসীরা তাঁদের ভূমি রক্ষা করতে পারছে না৷ এখন সময় এসেছে আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯ অনুস্বাক্ষর করার৷ অনেকে বলেন, অনেক দেশ তো করেনি, যেমন ভারত৷ কিন্তু ভারতে আদিবাসীরা অনেক রাজ্যে বৃহত্তর স্ব-শাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ভোগ করছে এবং আইনী নানা অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা দ্বারা স্বীকৃত৷ তাছাড়া অন্যরা না করলেও আমরা কেন পথ দেখাবো না? নেপাল আইএলও কনভেনশন নং ১৬৯ ইতিমধ্যে রেকটিফাই করেছে৷ আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি৷ এই ১৬৯ নং কনভেনশন রেকটিফাই হলে আদিবাসীদের সঙ্গে সরকার, আইএলও, সবার মধ্যে সমন্বিত কাজের ক্ষেত্র বাড়বে, সহযোগিতা বাড়বে, আদিবাসীদের উপকার হবে, সরকারও সম্মানিত হবে৷ উভয়ের মর্যাদা বাড়বে৷ আস্থা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়বে, আলোচনা ও সংলাপের দুয়ার আরো উন্মুক্ত হবে৷

আদিবাসী ইস্যুতে পৃথিবীর অনেক দেশ এগিয়ে যাচ্ছে৷ নরওয়েসহ স্ক্যানডিনেভিয়ান কয়েকটি দেশে আদিবাসী ‘সেমি পার্লামেন্ট' আছে৷ আমরা তাদের উদাহরণ দিই৷ নেপালের কনস্টিটিউশন অ্যাসেম্বলিতে জনজাতিদের বড় ভূমিকা এবং ওদের সংসদের স্পিকার ছিলেন লিমবু আদিবাসী৷ এক সময় ভারতের স্পীকার ছিলেন মেঘালয়ের একজন গারো৷ 

বাংলাদেশে আদিবাসীদের জীবনে মূল অবলম্বন হলো ভূমি৷ অথচ যুগ যুগ ধরে আদিবাসীরা তাঁদের ভূমি হারিয়েছে৷ বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেও যেমন বাঁধ নির্মান (কাপ্তাই), ন্যাশনাল পার্ক, ইকো-পার্ক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বাঁধ, সামাজিক বনায়ন, মিলিটারি বেইস নির্মাণ ইত্যাদির কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছে৷ ইকো-পার্ক প্রকল্পের ফলে খাসিয়া (নিজেরা খাসি বলেন) ও গারোরা উচ্ছেদ হতে বসেছিল৷ পরে আদিবাসীদের আন্দোলনের ফলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়নি৷ কিন্তু মধুপুরে আদিবাসীদের জীবন দিতে হয়েছে৷ এর কোনো বিচারও হয়নি৷ অন্যদিকে, প্রভাবশালী শক্তিমান ভূমিগ্রাসী চক্র ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছে জোর করে৷ জাল দলিল দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে, নানারকম মামলা দিয়ে স্বর্বশান্ত করেছে আদিবাসীদের৷ দেশান্তরী হওয়ার কারণেও আদিবাসীরা অনেক জমিজমা হারিয়েছে৷ তাঁদের জমি ‘শত্রু সম্পত্তি' বা অর্পিত সম্পত্তি হয়ে গেছে৷ আদিবাসীরা হয়তো কখনও কখনও আইনের আশ্রয় নিয়েছে, মামলা করেছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালাতে গিয়ে আরও নিঃস্ব হয়েছে৷ বছরের পর বছর আদিবাসীরা মামলা করে জমি ফেরত পেয়েছে– এ রকম নজির বলতে গেলে খুব একটা নেই৷

এখনও জমি হারাচ্ছে আদিবাসীরা আর অসহায়ভাবে দেখছে যে, তাঁদের পাশে দাঁড়াবার বিশেষ কেউ নেই৷ শুধু ভূমিলোভী চক্র নয়, বা কখনও কখনও বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে শুধু নয়, ‘পপুলেশন ট্রান্সফার'-এর কারণে আদিবাসীদের জায়গা-জমি অন্যের দখলে চলে গেছে৷ খাসি পাহাড়ে বা মধুপুর বনে আদিবাসীরা বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে বা এই ধরনের প্রকল্প চায় না, কারণ, তাতে দীর্ঘদিন ধরে যে ভূমিতে তাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে বসবাস করছে, ভূমি ব্যবহার করছে, তার মালিকানা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে৷ বিশেষত ভূমিতে দখলিসত্ত্ব নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে– এই ভয়ে ও অনিশ্চয়তায়৷

পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে রাখাইনদের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হওয়ার পথে৷ তাঁদের জমিজমা, মন্দির, শ্মশান, ভিটেমাটি– সব দখল হয়ে গেছে৷ এক সময় এই অঞ্চলে লক্ষাধিক রাখাইন বসবাস করতেন৷ এখন এই অঞ্চলে রাখাইন জনসংখ্যা আড়াই হাজারেরও কম৷ অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছেন অথবা অন্যত্র চলে গেছেন নিরাপত্তার কারণে৷

বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইনে আদিবাসীদের ভূমি অ-আদিবাসীদের নিকট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিমালা থাকার পরও আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছে৷ কারণ, আইন যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে না এবং এ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নেই৷ তাই সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের৷ আদিবাসীদের ভূমি বিদ্যমান প্রচলিত আইন দিয়ে ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না, এটি এখন সবাই স্বীকার করেন৷

Bangladesch Sanjeeb Drong
সঞ্জীব দ্রং, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামছবি: Sanjeeb Drong

আদিবাসীরা কী কী কারণে ভূমি হারায়

১. রাজনৈতিক পপুলেশন ট্রান্সফার এবং বাধ্যতামূলক দেশান্তরকরণ প্রক্রিয়া একটি হীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক হাতিয়ার৷ কাপ্তাই বাঁধ, ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা, ইকো-পার্ক ও নানা নিপীড়নমূলক কাজ এর অন্তর্ভুক্ত৷ সর্বশেষ মধুপুর বন উজাড় করে অ-আদিবাসীদের বনের জমি লিজ দেয়া৷ এভাবে অসংখ্য আদিবাসী গ্রাম, বসতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷

২. আদিবাসীদের কোনো মতামত বা সম্মতি ছাড়াই আদিবাসীদের ভূমিতে ও এলাকায় জাতীয় উদ্যান, ইকো-পার্ক নির্মাণ, সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ;

৩. আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত, ব্যবহৃত ভূমিকে আদিবাসীদের না জানিয়েই রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা বা খাস করে দেয়া;

৪. উচ্ছেদ নোটিশ এবং শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে আদিবাসীদের হয়রানি ও শেষ করে দেয়া;

৫. শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি আইন;

৬. ভূমিলোভী চক্রের জাল দলিল, জোরপূর্বক জমি দখল;

৭. সরকারি ভূমি অফিসের দুর্নীতি ও আদিবাসীদের সাথে প্রতিপক্ষমূলক আচরণ;

৮. ভূমি জরিপের সময় দুর্নীতি ও ঘুস দিতে বাধ্য করা; ঘুস না দিলে জমি খাস করে দেয়া;

৯. -    আইনের আশ্রয় না পাওয়া, এমনকি মামলায় জয়ী হলেও জমির দখল বুঝে না পাওয়া;

১০.     বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ মামলা চালাতে গিয়ে আরও জমিজমা হারানো, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হওয়া;

আদিবাসীদের অন্যতম দাবিসমূহ হলো –

-        আবার সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ ভূমি ও সম্পদের উপর অধিকার নিশ্চিত করা;

-        সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করা;

-        পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন কার্যকর করা;

-        আদিবাসীদের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তাঁদের অর্থপূর্ণ অংশিদারীত্ব নিশ্চিত করা এবং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা৷

-        জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন এবং আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ বাস্তবায়ন করা এবং ১৬৯ রেকটিফাই করা;

-        আদিবাসী অধিকার আইন (ইনডিজিনাস পিপলস্ রাইটস অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য