দেশবাসীদের জন্যই প্রয়োজন আদিবাসীদের
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬মানব ইতিহাস হিংসাময়, সহিংস৷ সবলের জয়, দুর্বলের পরাজয়৷ আধুনিকতার জয়, প্রাচীনপন্থার পরাজয়৷ তাই পৃথিবী জুড়ে, দেশের পর দেশে দেখা যায় , প্রভাব ও আধিপত্যশালী মুখ্য নৃগোষ্ঠীর পাশাপাশি মুখ গুঁজে বাস করে চলেছেন সেই ভূখণ্ডের আদিবাসীরা৷ উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে পুঁজিবাদ বা বিশ্বায়নের প্রতিটি ঢেউয়ে প্রথমেই মুখ থুবড়ে পড়ছে তাদের পর্ণকুটিরগুলি৷ তারা হন ধর্মের শিকার, শুচি-অশুচির শিকার, শোষণের শিকার৷ তবে তারা আছেন কেন? তারা উধাও হন না কেন? দেশ বা সমাজের কোন কাজে লাগেন তারা?
কথাটা নিউজিল্যান্ডের মানুষ ও সরকার বহু আগে বুঝতে শিখেছেন – যে কারণে মাওরিদের সম্পর্কে সে দেশ বিশেষভাবে সচেতন ও সচেষ্ট৷ অস্ট্রেলিয়ার সরকার ও জনতা ধীরে ধীরে বুঝছেন, তথাকথিত অ্যাবরিজিনরা অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতির, পঞ্চম মহাদেশটির অতীতের, অতীত ইতিহাসের কত বড় অঙ্গ৷ ক্যানাডা সরকার ‘ইন্ডিয়ানদের' জন্য যা করার চেষ্টা করছেন, মার্কিন সরকার তথাকথিত রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য, ঠিক হোক, ভুল হোক, যা করার চেষ্টা করছেন ও ভবিষ্যতে আরো বেশি করে করবেন – এ সবের পিছনে রয়েছে একটি তত্ত্ব, যার নাম হলো জীববৈচিত্র্য, প্রাণীবৈচিত্র্য৷
বৈচিত্র্য ছাড়া জীবন বাঁচে না, বাড়ে না, বিকাশ পায় না৷ সংমিশ্রণই মানবজাতির বিকাশ ও প্রগতির মূল কারণ – শুধু মানবজাতিরই বা কেন? ‘জিন পুল'-এর কথা আমরা সবাই জানি৷ কোনো প্রজাতির জিন পুলে বৈচিত্র্য কমে এলে, সে প্রজাতির বিলুপ্ত হবার বিপদ দেখা দেয়৷ সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই বৈচিত্র্যের প্রয়োজন৷ কোন সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো সংস্কৃতির ঠোক্কর বা টক্কর থেকে যে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পরবর্তী প্রেরণা আসবে, তা বড় বড় নৃতত্ত্ববিদরাও বলতে পারবেন না৷
আবার ভেবে দেখুন, এই যে আজকাল ‘অরগ্যানিক ফার্মিং', ‘অরগ্যানিক' খাবারদাবার নিয়ে সকলের এতো উৎসাহ, তার মূল কথাটা হলো এই যে, ‘অরগ্যানিক' কলা-মুলোর আকৃতি একটু বিদ্ঘুটে হয় আর বালি-কাদা একটু বেশি থাকে বটে – কিন্তু সেটাই তো তার ‘বিশুদ্ধতার', অর্থাৎ বিশুদ্ধভাবে ‘অরগ্যানিক' হওয়ার প্রমাণ৷ অর্থাৎ বিশুদ্ধ না হওয়াটাই বিশুদ্ধতার প্রমাণ! বঙ্গদেশ যে বাঙালিদের রাজত্ব, সেটা কিছু অবাঙালি না থাকলে উপলব্ধি করবেন কি করে, আর বাঙালিত্বের মজাটাই বা পাবেন কী করে?
চিকিৎসাশাস্ত্রে বলে, শরীরে অ্যান্টিবডি থাকলে জীবাণুরা কিছু করতে পারে না৷ সংখ্যালঘুরা হলেন ‘বডি পলিটিকের' সেই অ্যান্টিবডি৷ তাদের উপস্থিতি আমাদের জাতীয় সত্তাকে আরো সুস্থ, আরো জোরদার করে৷ আর যদি এতেও না হয়, তাহলে পরিবেশবাদীদের তূণ থেকে আরো একটা যুক্তি যোগ করতে পারি: বন-বনানীর ক্ষেত্রে ‘মোনোকালচার' কা-কে বলে, জানেন তো? অর্থাৎ মাইলের পর মাইল একই গাছের বন, একই গাছের চাষ, কোথাও ইউক্যালিপ্টাস তো কোথাও অয়েল পাম৷ এর ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, মাটির ক্ষতি হয়, জীবজন্তুর ক্ষতি হয়, শেষমেষ মানুষের ক্ষতি হয়৷
কাজেই নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রেও (সরকারি ভাষায়) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলিকে উপেক্ষা করবেন না৷ আমাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা, সতেজ রাখার পিছনে তাদের যে কি অবদান, তা শেষমেষ শুধু সৃষ্টিকর্তা আর তাঁর কাজের বুয়া প্রকৃতিরাণীই জানেন৷
অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর লেখাটি নিয়ে কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷